রাজধানীতে বিনা পয়সার খাবার

রাজধানী শহরে আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা যেমন আছে, তেমনি আছে বস্তি ও ফুটপাত। এখানে  হাতের কাছেই দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের হোটেল, বিলাসবহুল এসব হোটেলে দেশি-বিদেশি খাবার চলে দেদার। খাওয়াদাওয়ার জমজমাট আয়োজনের মধ্যে আরেক চিত্রও রয়েছে। এ শহরে অজস্র মানুষ রয়েছে, যারা তিন বেলা আহার জোগারের সংগ্রামে লিপ্ত। শহরের তথাকথিত নিচুতলার হাজার হাজার মানুষকে প্রতিনিয়ত লড়তে হয় রুটি-রুজি জোগাড়ের সংগ্রামে। নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ, সবার সংগ্রাম একটাই  তিন বেলা পেটভরে খাওয়া। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে সবচেয়ে কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। একটু ভালো খাবার খাওয়ার জন্য প্রতিদিন শত শত মানুষ অপেক্ষায় থাকে। ভিড় করে বিভিন্ন জায়গায়। 

রাজধানীতে খুঁজলে এমন কিছু মানুষ, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা ক্ষুধার্ত ও প্রান্তিক মানুষের টিকে থাকার যুদ্ধে সহযোগী। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় অভাবী মানুষের দিকে। তারা নিম্ন আয়ের মানুষকে বিনা মূল্যে খাবার দেয়। মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে কাজ করে নিঃস্বার্থে। এমন কয়েকটি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হলো।

মেহমানখানা

ধানমন্ডি ১৫, বাসস্ট্যান্ডের কাছে সাতমসজিদ রোডের ৭৬৪ নম্বর বাড়ির সামনে থেকে শংকর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত গেলে দেখা মিলবে রাস্তার পাশে সারি সারি রিকশাচালক যাত্রীর আসনে বসে খিচুড়ি খাচ্ছেন। মধ্যাহ্নভোজের এই চমকপ্রদ দৃশ্য রোজ দুপুরে ঘণ্টা কয়েকের জন্য চোখে পড়বে। বিনা খরচায় আয়োজনটি মূলত নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য, তবে এই মেহমানখানায় আসতে বাধা নেই কারোরই। এই খাদ্য বিতরণ চলছে ২০১২ সালের শেষ দিক থেকে। রোদ- ঝড়বৃষ্টি যা-ই থাক, প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে শুরু হয় খাবার বিতরণ। আনুমানিক দুই হাজার লোক প্রতিদিন খেতে আসে এখানে। রিকশাচালক ছাড়াও আছেন নারী গৃহকর্মী, বিভিন্ন অফিসে কর্মরত নিম্নপদের কর্মচারী, বহুতল ভবন বা বাণিজ্যিক ভবনের নিরাপত্তাকর্মী, দোকান কর্মচারী এমনকি আশপাশের হাসপাতালে ভর্তি থাকা অনেক রোগীর আত্মীয়রাও চলে আসে এখানে। পয়সা ছাড়াই আপ্যায়িত হয় ধোঁয়া ওঠা গরম খিচুড়িতে। এই আয়োজন করেছেন আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এম এনামুল হক। প্রতিদিন এত মানুষের খাওয়ার আয়োজনের এ চিত্র বিরল।

‘ভালো কাজের হোটেল’

‘ভালো কাজের হোটেল’ নামে একটি সংগঠন এরই মধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে নিম্ন আয়ের মানুষকে খাবার খাওয়ানোর কারণে। কারওয়ান বাজার মোড়ের পাশ দিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট রোডে একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে একটি রঙিন দেওয়াল, যাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা  রয়েছে ‘ভালো কাজের হোটেল’। এর কাছেই সাতরাস্তার মোড়ে রয়েছে এমন আরো একটি। এ দেওয়ালগুলো আসলে একটি হোটেল, যেখানে সপ্তাহে সাত দিন মানুষকে বিনা মূল্যে খাবার খাওয়ায় ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন। দিনে অন্তত একটি ভালো কাজ করলেই এখানে খাবার খেতে পারেন যে কেউ। ২০১৯-এর ডিসেম্বর থেকে ‘ভালো কাজের হোটেল’ পরিচালনা করে আসছে ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’। শুভাকাঙ্ক্ষী আর সদস্যদের মাসিক চাঁদা দিয়ে চলে সব কার্যক্রম। ঢাকা শহরে মোট ১০ জায়গায় এই আয়োজন করা হয়। দুপুরে মিরপুর, কালশী, সাতরাস্তা, কারওয়ান বাজার, ওয়ারী এবং বনানী কড়াইল বস্তিতে, আর রাতে বাসাবো, কমলাপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডিতে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামেও এ হোটেল পরিচালিত হয়।

‘দস্তরখানা’র খাবার

ভালো কাজের হোটেলের মতো একইভাবে মানুষকে খাবার খাওয়ায় ‘দস্তরখানা’ নামের একটি সংগঠন। নিউ ইস্কাটন রোডে ফ্লাইওভারের নিচে সপ্তাহে ছয় দিন চলে তাদের কার্যক্রম। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক মানুষ এখানে খাবার খেয়ে থাকে। দুপুর ১২টার আগে থেকেই ফ্লাইওভারের ছায়ায় জড়ো হতে থাকে সবাই। খাবার আসে ঠিক ১টায়। এখানে খেয়ে স্বস্তির দিন কাটে অনেক অসহায় মানুষের।

হাইকোর্ট মাজার

হাইকোর্ট মাজার। শাহ খাজা শরফুদ্দীন চিশতি (র.)-এর দরবার শরিফ সবার কাছে পরিচিত। এখানেই সপ্তাহে সাত দিন, অন্তত দুই বেলা খাবার মেলে মানুষের। হাইকোর্ট মাজারে আসা ছিন্নমূল মানুষের কাছে এ এক ভরসার নাম। অন্য কোথাও না পেলে এখানে কিছু না কিছু খাবার পাবেনই, এমন ভাবনা নিয়ে তারা আসে। অনেক উচ্চ আর মধ্যবিত্তও খাবার খায় এখানে। মাজারের খাদেম হাজি আমজাদ হোসেন জানান, আগে সকালেও খাবার দেওয়া হতো। অনুদান কমে যাওয়ায় শুধু দুপুর আর রাতের খাবারের আয়োজন করা হয়। একেক দিন একেক ধরনের খাবারের ব্যবস্থা থাকে। ভাত, খিচুড়ি, তেহারি, যে সময় যা তৈরি হয়, তা দিয়েই মানুষের খেদমত করেন তারা। 

গোলাপ শাহ (র.)-এর মাজার

গুলিস্তানের গোলাপ শাহ (র.)-এর মাজারের ভক্ত-খাদেমদের উদ্যোগেও বিভিন্ন সময়ে খাবারের আয়োজন করা হয়। এখানে প্রতি রাতে ১০০ কলা ও ২০০ রুটি খাওয়ানো হয় এক ভক্তের উদ্যোগে। এ ছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে খাওয়ানো হয় খিচুড়ি।

কমলাপুর রেলস্টেশন

ঢাকা শহরের একটি বড় ছিন্নমূল মানুষের বাস কমলাপুর রেলস্টেশন ঘিরে। সারা দিন নানা  জায়গায় বিভিন্ন পেশার কাজ করে অনেকে রেলস্টেশনেই এসে ঘুমিয়ে থাকে। এখানে থাকা মানুষের তিনবেলা খাবারের চাহিদা পূরণে কাজ করে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা এনজিও ‘লিডো’ এগুলোর মধ্যে অন্যতম।

গুরুদুয়ারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত শিখ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উপাসনালয় গুরুদুয়ারায় প্রতি শুক্রবার সাধারণ মানুষের জন্য খাবার পরিবেশন করা হয়। ধর্মীয় সংগীত পরিবেশনের পর উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করা হয়, যা খেতে আসে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ভজন সংগীত শোনার জন্য অনেকেই মাথায় একখণ্ড কাপড় বেঁধে বসে থাকে, উপভোগ করে এ আবহ। এরপর পরিবেশন করা হয় খাবার।

এমন একটি-দুটি না, সমাজের বেশির ভাগ বিত্তবান এগিয়ে এলে স্বল্প আয়ের মানুষের পেটপুরে খাওয়ার সংকট আর থাকবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh