সীমান্তে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের জন্য কতটা উদ্বেগের?

বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মংডু শহর এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পুরো এলাকায় আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নাফ নদের বাংলাদেশ অংশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

১৩ ডিসেম্বর সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও কোস্ট গার্ডের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কেউ যেন বাংলাদেশের জলসীমা অতিক্রম করে মিয়ানমারের জলসীমায় না যায়, সে ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। একই সঙ্গে জরুরি প্রয়োজনে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে যাত্রীবাহী নৌযান চলবে কোস্ট গার্ডের নিরাপত্তায়। আর সেন্ট মার্টিনের পর্যটকদের বহনকারী জাহাজ ছাড়বে কক্সবাজার থেকে। অর্থাৎ নাফ  নদের যে অংশে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ আছে বা যে অংশটি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্য আছে, সেই এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।

প্রসঙ্গত, আরাকান আর্মি (এএ) মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যভিত্তিক একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তারা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) সামরিক শাখা। রাখাইনে ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এক রকম স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনই তাদের লক্ষ্য। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি তুলে আরাকান আর্মি গঠিত হয় ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল। গত ৮ ডিসেম্বর থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের গণমাধ্যম ‘ইরাবতী’র খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পুরো ২৭০ কিলোমিটার এলাকা এবং মংডু শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে আরাকান আর্মি।

এই ঘটনার পর নাফ নদের মিয়ানমারের অংশে অনির্দিষ্টকালের জন্য নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আরাকান আর্মির এক বিবৃতিতে বলা হয়, তারা সফলভাবে রাখাইন রাজ্যের মংডু অঞ্চলের সামরিক জান্তার বর্ডার গার্ড পুলিশ ডিভিশনের (৫ নম্বর) শেষ অবশিষ্ট ফাঁড়িটি দখল করেছে এবং নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এতে সামরিক জান্তার সশস্ত্র সদস্য, তাদের সহযোগী আরএসও, আরসা, এআরএ সদস্যরা এখন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তারা অতর্কিত হামলা অব্যাহত রেখেছে। তাই সামরিক প্রয়োজনীয়তা এবং জননিরাপত্তাসংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে নাফ নদে (রাখাইন প্রান্তে) সব নদী পরিবহন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির পুরো সীমান্ত এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর স্বভাবতই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার মানুষের মনে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকবার সীমান্তের ওপারে তীব্র গোলাগুলির শব্দে টেকনাফের মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ওপার থেকে দু-একটা গুলিও এসে পড়ে বাংলাদেশের স্থলভাগে। কক্সবাজারের সাংবাদিক তৌহিদুল ইসলাম জানান, রাখাইনে এতটাই বোমাবর্ষণ হয়েছে যে টেকনাফের সীমান্তসংলগ্ন এলাকার ঘরবাড়িও কেঁপে উঠেছে। বিশেষ করে শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ার পূর্বে মিয়ানমারের মগনীপাড়া, পতুংজাপাড়া, সাবারাংয়ের আচারবুনিয়া এলাকার পূর্বে মিয়ানমারের সুধাপাড়া, উকিলপাড়া, সিকদারপাড়া, ফয়েজীপাড়া এলাকা থেকে গোলাগুলির শব্দ বেশি এসেছে। 

আরব নিউজের একটি খবরে বলা হয়, রাখাইন রাজ্য বর্তমানে মিয়ানমারের দেশব্যাপী গৃহযুদ্ধের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গোষ্ঠী ও জাতিগত মিলিশিয়ারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো আরাকান আর্মি যেহেতু কোনো বৈধ বা স্বীকৃত সংস্থা নয়, তাই তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ নেই। সে কারণে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি ও টহল বাড়িয়েছি বাংলাদেশ- যাতে অনুপ্রবেশ ঠেকানো যায়। বিজিবির মেজর মোরশেদের বরাত দিয়ে ওই খবরে বলা হয়, সীমান্ত এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা নিশ্চিত করতে নৌবাহিনী, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড এবং পুলিশের এলিট ফোর্স র‍‍্যাব মোতায়েন করা হয়েছে।

সীমান্তবর্তী আরাকান রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হাতে যাওয়ার ফলে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বস্তুত রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব যত বাড়বে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি তত বেশি জটিল হবে। রাখাইন অঞ্চলে জান্তা সরকারের কর্তৃত্ব দুর্বল করে আরাকান আর্মির প্রভাব বাড়ায় এটি রোহিঙ্গা সংকটের জন্য ‘শাঁখের করাত’ হতে পারে। তার কারণ সাধারণত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের মধ্য থেকে আরাকান আর্মির সদস্য নিয়োগ করা হয়। ফলে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের সংবেদনশীলতা থাকার সম্ভাবনা কম। এমনকি তারা ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকারও করে না। ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আরাকান আর্মি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে বা তাদের এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে গেলে মিয়ানমার সরকার সেটিকে কীভাবে দেখবে- সেটিও বড় প্রশ্ন।

বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে রাখাইন রাজ্যের দুটি পথ হচ্ছে বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মি- দুই পক্ষের জন্যই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সেন্ট মার্টিনের অবস্থানের কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগরের বেশির ভাগ এলাকাই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে পড়ে। কাজেই ভবিষ্যতে রাখাইন রাজ্যকে অনেকটাই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাখাইনে যদি আরাকান আর্মির শতভাগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বড় ধরনের দরকষাকাষির সুযোগ সৃষ্টি হবে বলেও অনেকে মনে করেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh