পৌষের শুরুতে কুয়াশার সঙ্গে হাড় কাঁপানো শীতে জনজীবন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। সন্ধ্যার পরই নেমে যাচ্ছে তাপমাত্রার পারদ। শীতের দাপটে রীতিমতো কাবু দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ। কুয়াশায় ব্যাহত হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। হিম ঠান্ডা থেকে বাঁচতে নেই পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র। অন্য বছর শীতবস্ত্র বিতরণে সাড়া মিললেও এবার শীতার্তদের পাশে তেমন কেউ নেই।
সরকারি সামান্য বরাদ্দের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে কোটি দরিদ্র মানুষকে। সরকার প্রতি জেলায় অপ্রতুল কম্বল বরাদ্দ দিলেও শীতের কারণে যাদের রুটিরুজি বন্ধ, তাদের কথা কেউ ভাবছে না। ঘন কুয়াশায় কৃষকের মাথায় হাত পড়লেও কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে নেই কোনো প্রণোদনা। দুর্যোগপূর্ণ এমন আবহাওয়ায় দেশ যখন স্থবির, তখন এ নিয়ে নেওয়া হয়নি আলাদা কোনো উদ্যোগ।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ধরা হলেও তীব্র শীত নিয়ে নেই আলাদা প্রস্তুতি বা বিশেষ বরাদ্দ। হতদরিদ্র শীতার্ত মানুষ ঠকঠকিয়ে কাঁপলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এখনো কিনতে পারেনি ত্রাণের কম্বল। গেল বছর কম্বল নিয়ে একই বিপত্তিতে পড়েছিল সরকার। এবার নভেম্বরে দরপত্র আহ্বান করার পরও কম্বল কিনতে না পেরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে নগদ টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। সেই টাকায় স্থানীয় বাজার থেকে মানহীন কম্বল শীতার্ত মানুষকে গছানোর অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা কিছু কম্বল বিতরণ করে নিজেদের দায়িত্ব সারতে চাইছেন।
এ সময়ে এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় শীতার্তদের তালিকা তৈরি ও বিতরণেও লেগেছে ভজকট।
ত্রাণের কম্বল কেনার জন্য গত ৯ নভেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর দরপত্র আহ্বান করে। এক মাসেও দরপত্রের সেই কম্বল আসেনি। অধিদপ্তর বলছে, দরপত্রের পর অনেক প্রক্রিয়া শেষ করেই কম্বল সরবরাহ করা হয়। অল্প কিছু দিনের মধ্যে কম্বল পাওয়া যাবে। তবে এরই মধ্যে শীত বেড়ে যাওয়ায় জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের অনুকূলে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, নিম্নমানের কম্বলের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকার দরপত্রে অনেক শর্ত দিয়েছে। কম্বলের গুণগত মান নির্ধারণ করে স্পেসিফিকেশন ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। কম্বলের দৈর্ঘ্য ৮ ফুট এবং প্রস্থ ৬ ফুট। ডাবল পার্ট, বোথসাইড ব্রাশ, অ্যান্টি পাইলিং, ওজন ২৫০০ গ্রাম এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। এই শর্ত মেনে যারা কম্বল সরবরাহ করবে, শুধু তারাই যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। ফলে শর্তের মারপ্যাঁচে কেনাকাটা জটিল হয়ে পড়ে। এতে প্রতি বছর কম্বল কিনতে দেরি হচ্ছে।
তবে প্রতি বছর অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে কম্বল কিংবা অর্থ বরাদ্দে তথ্য থাকলেও এবার তা নেই। এদিকে মহাপরিচালকের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল কম। ভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে শীতবস্ত্রের জন্য হাহাকার দেখা গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের জেলা পর্যায়ে পাঠানো টাকায় যে কম্বল কেনা হয়েছে তাতে শীত মানছে না। এসব কম্বলে শীত নিবারণের মূল উপাদান উলের অস্তিত্বই নেই। কুড়িগ্রামের বাসিন্দা নুর হোসেন বলেন, ‘দুই পাটের (স্তর) হলে ভালো হতো। কম্বল খুবই পাতলা, আর আকারও অনেক ছোট। একজনের বেশি থাকা যায় না।’
ঠাকুরগাঁওয়ের আবদুর রহমান বলেন, ‘শীতে সরকারিভাবে যে কম্বল দেওয়া হয়, তা খুবই নি¤œমানের। গত বছর ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায় যে কম্বল বিক্রি হয়েছে, তা সরকারি কম্বলের চেয়ে অনেক ভালো।’ অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে শীতবস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়ার রেওয়াজ থাকলেও এবার সামাজিক, রাজনৈতিক, মানবিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের তরফ থেকে বড় পরিসরে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক উত্তাপে শীতে বিপর্যস্ত মানুষের কষ্ট গণমাধ্যমে উঠে আসছে না। এ ছাড়া গত বন্যায় মানবিক উদ্যোগ নানা বিতর্কের মুখে পড়ে। ফলে এখন আর খুব বেশি মানুষ এসবে যুক্ত হতে চায় না।
এদিকে রাজধানী ঢাকায় ছিন্নমূল মানুষকে শীত থেকে বাঁচাতে ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কমিশনার না থাকায় শীতবস্ত্র বিতরণে কোনো তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে না।
প্রতিবছরই শীত মৌসুমে ঠান্ডাপ্রবণ এলাকায় মানুষের কাজের সুযোগ কম থাকে। তবে এবারের শীতে দিনমজুরি কাজের পরিধি অন্য সময়ের চেয়ে কমেছে। এই পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য দরকার মানবিক সহায়তা। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বর্তমানে শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষ ভয়ানক কষ্টে আছে। শীতে মানুষ কষ্ট পাবে আর কেউ কেউ শহরে বসে লেপ-কম্বল-জ্যাকেট-সোয়েটার মুড়ে শীত উপভোগ করবে, সেটা অমানবিক। কনকনে শীতে দেশের যেসব জেলার মানুষ কাঁপছে, তাদের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করা সবচেয়ে জরুরি কাজ। এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি অবস্থাসম্পন্ন মানুষ ও সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। শীতার্ত মানুষকে বাঁচাতে শৈত্যপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করা উচিত। তাহলে সে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা নেওয়া সহজ হবে।
এ ব্যাপারে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মমিনুল ইসলাম বলেন, “শীত কিংবা শৈত্যপ্রবাহকে ‘দুর্যোগ’ ধরা না হলেও আমরা নিয়মিত আগাম তথ্য দিয়ে মানুষকে সতর্ক করছি।”
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh