আন্দোলনে স্বৈরশাসক উৎখাত

প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট ২০২৪ সালের বর্ষসেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করেছে। মূলত চলতি বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন  তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরশাসক উৎখাতে বিজয়ী বলেই বাংলাদেশকে এবার সেরার তালিকায় আনা হয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর ইকোনমিস্ট এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই স্বীকৃতি ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি কৌশলগত অবস্থান তৈরি করবে। 

বিশ্লেষক ও বিজ্ঞজনেরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য এই স্বীকৃতি যেমন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে, তেমনই কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আর চ্যালেঞ্জগুলো হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নেতৃত্বে স্থিতিশীলতা, উন্নয়নের সুফল সবার মাঝে পৌঁছে দিয়ে বৈষম্য দূর করতে না পারলে এই স্বীকৃতির প্রভাব ম্লান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সেই অর্জন, এটাকে কাজে লাগিয়ে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আনা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব কমিয়ে আনতে হবে। আর বাংলাদেশ যদি তার অর্থনৈতিক শক্তিকে আরো সুসংহত করে, তবে এটি ভারতকে নতুন করে কৌশল নির্ধারণে বাধ্য করতে পারে।

অন্যদিকে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে হটিয়ে দেশটির শাসনভার গ্রহণ করেছেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা।  আসাদের দুই যুগের নিষ্ঠুর শাসনে বাস্তুচ্যুতিতে রানার আপ সিরিয়া। এ বছর চূড়ান্ত তালিকায় ছিল পাঁচটি দেশ। বাংলাদেশ ও সিরিয়া ছাড়াও অন্য দেশগুলো হলো পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আর্জেন্টিনা।

দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, দেশের স্বাধীনতার একজন নায়কের কন্যা শেখ হাসিনা। একসময় দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। কিন্তু পরে দমনপীড়ন শুরু করেন, নির্বাচনে জালিয়াতি করেন, বিরোধীদের কারাগারে ভরেন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। তার আমলে বিরাট অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

ব্রিটিশ সাময়িকীর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেরা ধনী, সবচেয়ে সুখী বা নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী- এমন সব বিবেচনায় নয়; বরং গত ১২ মাসে বা এক বছরে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে সেই বিচারে সেরা দেশ নির্বাচন করা হয়েছে। সেরা দেশ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ইকোনমিস্টের সংবাদদাতাদের মধ্যে জোরালো বিতর্ক হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পরে বর্ষসেরা দেশ নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ। আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, যিনি সাড়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশটি ১৫ বছর ধরে শাসন করছিলেন বলে বাংলাদেশ বিষয়ে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এতে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলকালে প্রতিহিংসামূলক সহিংসতার ইতিহাস আছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ‘দুর্নীতিপরায়ণ’। ‘ইসলামি চরমপন্থা’ একটি হুমকি। তবে এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী পরিবর্তন আশাব্যঞ্জক। শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে। এটি ছাত্র, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের সমর্থন পেয়েছে। এই সরকার আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে ও অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করেছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারকে ২০২৫ সালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করা দরকার। কবে নির্বাচন হবে তাও নির্ধারণ করতে হবে। আদালতগুলোর নিরপেক্ষভাবে কাজ করা ও বিরোধী দলগুলোর সংগঠিত হওয়ার সময় পাওয়ার বিষয় প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনোটি সহজ হবে না। তবে একজন অত্যাচারী শাসককে হটানো এবং আরো উদার সরকার গঠনের পথে এগোনোর জন্য বাংলাদেশ আমাদের এ বছরের সেরা দেশ।

রানার আপ সিরিয়ার বিষয়ে সাময়িকীটি বলেছে, সিরিয়ায় এক যুগের বেশি সময় ধরে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে। স্বৈরশাসনের পতনের দাবিতে শুরু হওয়া সেই দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের শেষমেশ অবসান ঘটেছে। গত ৮ ডিসেম্বর বাশার আল আসাদের পতন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আসাদ পরিবারের দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর স্বৈরশাসন (বাশার ও তার বাবা হাফিজ আল-আসাদের শাসন) থেকে মুক্তি পেয়েছে সিরিয়াবাসী। ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় এই দেশে ছয় লাখের মতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। স্বৈরশাসক আসাদ তার বিরোধীদের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন ও ব্যাপক জুলুম-নির্যাতনের আশ্রয় নিয়েছেন। পাশাপাশি অর্থ কামাতে মাদক ব্যবসাকে নিয়ে গেছেন শিল্পের পর্যায়ে। তার পতনে সিরীয়বাসী উৎফুল্ল এবং এটি আসাদের ‘স্বৈরাচারসমর্থক’ রাশিয়ার জন্য উপহাসের। ইরানের জন্যও উপহাসের এ ঘটনা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh