আধুনিক দাসত্ব

মানব পাচার বিশ্বব্যাপী এক গুরুতর সমস্যা। এটি শুধু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন নয়, বরং মানবজাতির মূল্যবোধ ও সম্মানের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ। প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে, যারা অনেক সময় নির্যাতন, শোষণ এবং অবর্ণনীয় দুর্দশার মুখোমুখি হয়। মানব পাচার মূলত আধুনিক দাস প্রথারই একটি রূপ, যা জোরপূর্বক শ্রম, যৌন শোষণ, বাল্যবিবাহ এবং অঙ্গ পাচারের মতো অপরাধের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। দাসপ্রথা বহু আগে শেষ হলেও মানব পাচারের মাধ্যমে তা এখন ভিন্ন এক সংস্কারে রয়ে গেছে সমাজে। যার ফলাফলে শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, বিপর্যস্ত হচ্ছে গোটা সমাজ।  

‘ফোর্সড লেবার’ বা জবরদস্তিমূলকভাবে কাজ করানোর সঙ্গে ‘আধুনিক দাসত্বের’ সম্পর্ক অতি নিবিড়। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ওয়ার্ক ফ্রি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত  ‘গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স’ ২০১৬ সালে একটি সূচক প্রকাশ করে। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক সূচকে আধুনিক দাসত্বের শিকার মানুষের সংখ্যা আগের থেকে এক কোটির বেশি বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে জোরপূর্বক শ্রমকাজে অথবা বিয়েতে বাধ্য করা, বাণিজ্যিকভাবে যৌনকাজে ব্যবহার, মানব পাচারের শিকার লোকজন, তাদের সঙ্গে দাসদের মতো আচরণ এবং শিশুদের বিক্রি করাকে দাসত্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

উত্তর কোরিয়া, ইরিত্রিয়া ও মৌরিতানিয়া এই সূচকের শীর্ষ তিন দেশ। তথ্যানুযায়ী, দুই কোটি ৮০ লাখ মানুষকে জোরপূর্বক শ্রমকাজে এবং দুই কোটি ২০ লাখ মানুষকে বিয়েতে বাধ্য করা হয়। তালিকার শীর্ষে থাকা উত্তর কোরিয়ায় প্রতি হাজারে ১০৪ জন এই দাসত্বের শিকার হচ্ছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়ায় এক হাজার মানুষের মধ্যে ৯০ জন দাসত্বের শিকার। অন্যদিকে তৃতীয় স্থানে থাকা আফ্রিকার আরেক দেশ মৌরিতানিয়ায় প্রতি হাজারে ৩২ জন আধুনিক দাসত্বের শিকার। এ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত তালিকার শীর্ষ ১০-এ আছে। এসব দেশে আইন করে প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার সীমিত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া শীর্ষ ১০-এ আছে তুরস্ক, রাশিয়া, তাজিকিস্তান ও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের নাম। আধুনিক দাসত্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত বেশ কিছু মিল আছে। এর মধ্যে নাগরিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয় আছে।

যৌন শোষণ মানব পাচারের ভয়াবহ দিকগুলোর একটি। এতে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার হয়। এটি শুধু তাদের শারীরিক ক্ষতির কারণ নয়, বরং মানসিক ও সামাজিকভাবেও তাদের চরম দুর্দশার মুখোমুখি হতে হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এই শোষণ আরো ভয়ংকর রূপ নেয়, কারণ তারা সহজে প্রতিরোধ করতে পারে না। 

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ১০ হাজারের বেশি নারী ও শিশু পাচার হয়। বেশির ভাগই ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যৌন শোষণের জন্য পাচার করা হয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত দুই হাজার ৪০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এটি শুধু একটি উদাহরণ, এ রকম আরো অজস্র উদাহরণ রয়েছে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ২৭.৬ মিলিয়ন মানুষ বাধ্যতামূলক শ্রম ও যৌন শোষণের শিকার। পাচারের শিকার অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ পাচারের প্রক্রিয়াতেই মৃত্যুবরণ করে। অঙ্গ পাচার মানব পাচারের আরেকটি নির্মম রূপ। অনেক মানুষকে অপহরণ করে বা তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের অঙ্গ চুরি করে। বিশ্বব্যাপী অঙ্গ প্রতিস্থাপনের চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা এই অপরাধকে আরো উসকে দিচ্ছে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর ধনী মানুষেরা এই অঙ্গ পাচারের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। 

বাল্যবিবাহও আধুনিক দাস প্রথার একটি অংশ। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরা অর্থনৈতিক চাপে বা সামাজিক প্রথার কারণে তাদের সন্তানদের অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। এতে এই শিশুদের শৈশব কেড়ে নেওয়া হয় এবং তারা শারীরিক ও মানসিক শোষণের শিকার হয়।

মানব পাচারের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম বিদেশ যাওয়ার উচ্চ খরচ এবং বিদেশে গিয়ে প্রতিশ্রুত কাজ না পাওয়া। ভুয়া কাগজপত্র, অবৈধ নিয়োগপদ্ধতি এবং অনিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থাও এই সমস্যাকে জটিল করে তোলে। মানব পাচার প্রতিরোধে আইন থাকলেও এর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত হয় না।

পাচারকৃত ভুক্তভোগীদের বেশিসংখ্যক নিরক্ষর থাকায় দেশগুলোর আইন-কানুন সম্পর্কে ধারণা থাকে না। ফলে নির্যাতনের মতো অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় এগোতে পারে না। শিশুদের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি আরো ভয়ানক। তাদের জোরপূর্বক মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত করা হয়। এমনকি কোনো কোনো শিশুকে নেতিবাচক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ফলে এক অন্ধকার অমানিশায় ঘুরপাক খায় মানুষগুলোর ভাগ্যের চাকা। বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নের স্ফুলিঙ্গ ভাসিয়ে দেয় উত্তাল সাগরে।

মানব পাচার তথা আধুনিক ক্রীতদাস প্রথা সমাধানে বিদেশ যাওয়ার খরচ কমাতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়ানো এবং বৈধ প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানো নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে বিদেশে কর্মীদের অধিকার রক্ষায় দূতাবাসের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

মানব পাচার বন্ধে বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। তবে মানব পাচার প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সচেতনতার অভাব। অনেক মানুষ জানেই না যে তারা পাচারের ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। স্কুল, কলেজ এবং কর্মস্থলে মানব পাচার সম্পর্কে সচেতনতা কর্মসূচি চালানো জরুরি। মিডিয়ার ভূমিকা এখানেও গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়া এই বিষয়টিকে সামনে এনে জনসচেতনতা বাড়াতে পারে।

এ ছাড়া ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন এবং মানসিক সহায়তা প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাচারের শিকার ব্যক্তিরা প্রায়ই শারীরিক ও মানসিক ট্রমার মধ্যে থাকে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক সহায়তা, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও এই সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে তথ্য বিনিময় এবং যৌথ প্রচেষ্টা এই অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর হতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh