কাজী আনোয়ার হোসেনকে মাসুদ রানার জনক এবং সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই চেনেন সবাই। তবে এর বাইরেও তার নানা পরিচয় আছে। আগামী ১৯ জানুয়ারি তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তার জীবনের নানা দিক এবং ঘটনা নিয়েই এ আয়োজন। তথ্যগুলোর বেশির ভাগ তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার থেকে জানা।
মাছ শিকার
কাজী আনোয়ার হোসেনের মাছ ধরার নেশার শুরু ১৯৭৭-৭৮ সালে, ধানমন্ডি লেকে। এক সাক্ষাৎকারে কাজীদা বলেছিলেন, ‘সে সময় ধানমন্ডি লেকে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, ছেলে-বুড়ো, ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী-পেশাজীবী সবমিলিয়ে আমরা মৎস্যশিকারি ছিলাম তিনশোর ওপর। স্বাভাবিক নিয়মেই আমরা যে যার পছন্দের মানুষ খুঁজে নিয়ে ছোট ছোট দল গড়ে এক-একটা এলাকা দখল করতাম। আমি গিয়ে জুটেছিলাম স্বর্ণহৃদয় দুই শিকারি কালা ভাই (গোলাম রশিদ কালা, আচার প্রস্তুতকারক) ও রব ভাইয়ের (আবদুর রব, রঙের কন্ট্রাক্টর) গ্রুপে। এই গ্রুপে যুক্ত হন আরো অনেকেই।’
টানা ১০ বছর ধানমন্ডি লেকে নিয়মিত মাছ শিকার করেছেন তিনি। তার ধরা সবচেয়ে বড় মাছটির ওজন ছিল আধমণের মতো। এই নেশা এতটাই বেশি ছিল যে, কোনো কোনো দিন ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত লেকে ব্যস্ত থাকতেন মাছ শিকারে।
গুরু জিম করবেট!
কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেই একটি বিষয়ে গুরুর স্বীকৃতি দিয়েছেন বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটকে। আর সেটা মাছ শিকারে। তার কথায়, ‘আর এই ব্যাপারে আমার সাক্ষাৎ গুরু হচ্ছেন পৃথিবীবিখ্যাত ইংরেজ বাঘ শিকারি জিম করবেট। না, তার সঙ্গে পরিচয় হয়নি আমার কখনো; জীবনে কোনো দিন দেখাও হয়নি। আসলে তার একটি বই পড়েই হঠাৎ করে বেজে ওঠে আমার হৃদয়বীণা।’
শিকার কিংবা আউটিং
কাজীদার সেই অর্থে শিকারের নেশা ছিল না মোটেই। নিজেই বলেছেন, ‘শিকারের নেশা বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু কোনো দিনই পুরোপুরি ছিল না আমার। বাঘটাঘ টানেনি আমাকে। এমনকি রাজহাঁস বা চখা শিকারেও গিয়েছি মাত্র অল্প কয়েকবার। আমার মূল আকর্ষণ ছিল আউটিং। কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে শুক্রবারগুলোতে গাড়ি নিয়ে চলে যেতাম যেদিক খুশি, একেক দিন একেক রাস্তায়।
দলের বেশির ভাগই ছিলাম আমরা ধানমন্ডি লেকের মৎস্যশিকারি। আমাদের মধ্যে পাখি শিকারের পাগল ছিলেন লুডু খান। আমি ষাটের দশকেই পাখির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আশির দশকে রব ভাই, কালা ভাই আর আমি ছিলাম জেনুইন মৎস্যশিকারি...লুডু খানের পাল্লায় পড়ে আমরা সবাই জোট বেঁধেছিলাম পাখি শিকারে। লুডু ভাইয়ের এক নিপাট ভদ্রলোক বন্ধু শারফুদ্দীন টিপুও জুটে গিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে। রব ভাই তো উৎসাহের আতিশয্যে বন্দুক-রাইফেল-পিস্তল কিনে রীতিমতো বন্দুকবাজই বনে গিয়েছিলেন...’
ফটোগ্রাফার কাজী আনোয়ার হোসেন
কাজী আনোয়ার হোসেনের বড় নেশা ছিল ছবি তোলা। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ফটোগ্রাফি অনেক বড় শিল্প। আবার খুবই সহজ কাজ। বহু বছর ধরে ক্যামেরা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, যদিও শিল্প সৃষ্টির তাগিদে নয়। আমি মুহূর্তকে ধরতে চেয়েছি...’ আর এই ছবি তোলা নিয়ে মর্মান্তিক এক অভিজ্ঞতাও আছে তার। তার সামনেই মব লিঞ্চিংয়ের শিকার হয়েছিলেন এক যুবক। ১৯৭২ সালের ২২ জুন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সেই ঘটনার বর্ণনাও দেন কাজীদা। সেটাই তুলে ধরছি সংক্ষিপ্তভাবে।
সেগুনবাগিচায় নিজের বাড়িতে দোতলায় বসে লিখছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সকাল সোয়া ১০টার মতো বাজে তখন। হঠাৎ একটা পিস্তলের আওয়াজ ও হইচই শব্দ। রাস্তার তেমাথায় গ-গোল হচ্ছে। চিৎকার বেড়ে গেলে বারান্দায় এসে রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে তারা বলল, দুজন ডাকাত ধরা পড়েছে। ক্যামেরা নিয়ে ছুটলেন। গিয়ে দেখলেন কয়েকজন লোক মারছে এক যুবককে। লোকজন বলাবলি করছে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ব্যাংক লুট করে পালাচ্ছিল তিনজন হাইজ্যাক করা গাড়ি নিয়ে, ব্যাংকে একজনকে গুলি করে মেরে রেখে এসেছে, বাধা দেওয়ায় এক ট্রাফিক পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে। পুলিশ পিছু ধাওয়া করলে পালাতে গিয়ে রাস্তায় গাড়িচাপা দিয়ে মেরেছে দুজনকে। পরে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে পালানোর সময় গুলি ছুড়েছে রিভলবারের। একজন পালিয়ে গেছে। বাকি দুজন ধরা পড়েছে। লোকজন মারছে ওদের। ঠেলাঠেলির মধ্যে আরেকটু এগিয়ে ছবি তুলতে শুরু করেন। সবাই মারছে। ডাল ভেঙে নিয়েছে কেউ। এরই মধ্যে মোটা একটা মুগুর সংগ্রহ করে ফেলেছে একজন কোথা থেকে। কিল, ঘুষি, লাথি, কনুই চলেছে। মারের চোটে রাস্তায় শুয়ে পড়ল সিদ্দিক নামের একজন। পরে কাগজ দেখে নামটা জানতে পারেন কাজী আনোয়ার হোসেন। মেরেই চলেছে সবাই নেশাগ্রস্তের মতো।
ক্যামেরার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল ধাক্কাধাক্কিতে। ওদিকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পাঁচিল টপকে মহিলা পরিষদের অঙ্গনে লাফিয়ে পড়েছে অপর ছেলেটা, যার নাম ফারুক। ৩০-৪০ জন ঢুকে পড়ল পিছু পিছু। শিলাবৃষ্টির মতো পড়ছে কিলঘুষি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফারুকের পুরো শরীর। হঠাৎ দেওয়ালের পাশে কয়েকটা ১০ ইঞ্চি ইটের সন্ধান পেল জনতা। তাই দিয়ে মারতে শুরু করল দমাদম। ক্যামেরা হাতে কাজীদাকে দেখে ফারুক ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে।
‘বাঁচান, ভাই। আমারে বাঁচান।’ শেষ পর্যন্ত ফারুককে বাঁচানো যায়নি। মব লিঞ্চিংয়ের নির্মম উদাহরণ হিসেবে রক্তাক্ত ফারুকের ছবি কাজীদা ঠিকই তুলে ফেলেন, তবে তাকে বাঁচাতে না পারার যে অপরাধবোধ তার কথা উল্লেখ করেছেন লেখায়।
পরে জানা গেল, ব্যাংক লুট করেনি ওরা, গাড়িটা হাইজ্যাক করা কি না তাতে সন্দেহ আছে, ব্যাংকের কাউকে গুলি করে খুন করেনি ওরা, ট্রাফিক পুলিশ নিহত হয়নি ওদের গুলিতে।
লেখার ৮ বছর পর ছাপা হয় প্রথম বই কুয়াশা-১
কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখালেখির যাত্রা শুরু কুয়াশা-১ দিয়ে। কুয়াশা-১ ও কুয়াশা-২ লিখেছিলেন ১৯৫৬ সালে। ইচ্ছা ছিল ওগুলো বিক্রির টাকা দিয়ে একটা রাইফেল কিনবেন। কিন্তু বিনিময়ে যা পাওয়া যাচ্ছিল, তাতে একটা এয়ারগানও কেনা যায় না। বহুদিন পড়ে থাকল ও দুটো চিলেকোঠায় তার খাটের নিচে। বাবাকে (কাজী মোতাহার হোসেন) পাণ্ডলিপি দুটি দেখিয়ে বললেন, একজন প্রকাশক প্রতিটার জন্যে একশো করে টাকা দিতে চেয়েছেন। কাজী মোতাহার হোসেন ওগুলো পড়ে বলেছিলেন, ‘তোর তো শুনলাম প্রকাশক হওয়ার ইচ্ছা; রেখে দে এখন, ভালোই তো লিখেছিস, পরে নিজের প্রকাশনা থেকে বের করিস।’
১৯৬৩ সালের মে মাসে বাবার দেওয়া ১০ হাজার টাকা সম্বল করে শুরু হলো নতুন এক যাত্রার, যেটা পরে বাংলাদেশে পাঠকদের ভাবনার জগৎকেই পাল্টে দেয়। জন্ম নিল ‘সেগুনবাগান প্রকাশনী’র। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে কুয়াশা-১ সিরিজের মধ্য দিয়ে বের হয় প্রথম বই। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই নাম পাল্টে নতুন নাম রেখেছিলেন ‘সেবা প্রকাশনী’।
গান গাইতেন
১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন ঢাকা বেতারের তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী। এই গান গাইতে গিয়েই পরিচয় ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে। এক সাক্ষাৎকারে গল্পটা শুনেছিলাম কাজীদার মুখেই, ‘রেডিও পাকিস্তানের ঠান্ডা স্টুডিওতে। রেডিও অফিসটা তখন ছিল শাহবাগে। উনি তখন জনপ্রিয় কয়েকটা গান গেয়ে প্রতিষ্ঠিত সংগীতশিল্পী, আমিও অল্প-স্বল্প গান-বাজনার চর্চা করি, একটা-দুটো প্রগ্রাম পাই রেডিও-টিভিতে। মেয়েটির গলা ও চেহারা আমার পছন্দ হয়ে গেল প্রথম দর্শনেই। কাজেই কাছে ভিড়বার ছুতো খুঁজি। সেই আমলে অপরিচিত মহিলার সঙ্গে মেলামেশা সহজ ছিল না।’
‘অতএব ওদের পাঁচ বোনের সবচেয়ে ছোটটার জন্য বন্ধু জিয়া হায়দারের লেখা একটা গানে সুর আরোপ করে ওদের শান্তিবাগের বাসায় শেখাতে গেলাম- খোকন মণি সোনা, তোর দুটো রসগোল্লা থেকে একটা আমায় দে না, একটা আমায় দে না। আমি যে তখন কোন রসগোল্লার মোহে পড়ে ওই মহল্লায় ঘুর ঘুর করি নিজেও জানি না।’
আর্মচেয়ার ট্রাভেলার
এক সাক্ষাৎকারে প্রিয় কাজীদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মাসুদ রানাকে পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘুরিয়ে এনেছেন। আপনার কি দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়া হয়েছে কখনো। গেলে ওখানকার কোনো অভিজ্ঞতা বললে ভালো হতো।’ কাজীদার জবাব, ‘না ভাই। কোথাও না। আমি আর্মচেয়ার ট্রাভেলার। ১৪-১৫ বছর বয়সে একবার শুধু বিহারের কয়লা-শহর গিরিডিতে গিয়েছিলাম আমার আব্বুর সঙ্গে। স্মৃতি নেই কোনো। শুধু মনে আছে রাতে ঘুমাতে দেওয়া হয়েছিল দোতলার খোলা বারান্দায়; অসংখ্য উজ্জ্বল তারা ছিল আকাশে, আর বেশ দূরের শহর থেকে ভেসে আসছিল মুহম্মদ রফির গাওয়া সিনেমার গান- দিল্মে ছুপাকে পেয়ার কা তুফান লে চ্যলে/হ্যম আজ আপনি মওতকা সামান লে চ্যলে...
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh