কার্বোফুরান। দানাদার এই কীটনাশক এতটাই ভয়ংকর, জমিতে একবার ব্যবহার করলে ৩০ দিন পর্যন্ত ফসলে লেপ্টে থাকে এর বিষাক্ততা। এটি প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক- দুই কাজই করে। এই ‘শক্তিধর’ বালাইনাশক আগে ব্যবহার করলে পোকা আসে না ফসলের ধারেকাছে, আর কীটপতঙ্গ হানা দেওয়ার পর ব্যবহারে কীট মুহূর্তেই মারা পড়ে। কার্বোফুরানের বিষাক্ততা মানবস্বাস্থ্য ও আবাদযোগ্য জমির উর্বরতার জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে ২০১৬ সালে তা নিষিদ্ধের আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে গত ৩০ জুন কার্বোফুরান নিষিদ্ধ করে সরকার। পরে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের আবদারে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা গেল ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে কার্যকর নজরদারি না থাকায় যেন ফুরাচ্ছে না কার্বোফুরান। এখনো সারা দেশে প্রকাশ্যেই হচ্ছে এই কীটনাশক বিষের দেদার কেনাবেচা।
শুধু কার্বোফুরান নয়; দেশে ভূরি ভূরি মানহীন নিষিদ্ধ বালাইনাশকের (পেস্টিসাইড) কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে কৃষককুল। আবার ডিলারনির্ভর ব্যবসায়ীরা ‘লাভের গুড়’ খাওয়ার আশায় নানা কসরত করে বিদেশ থেকে নিম্নমানের বালাইনাশক উড়িয়ে আনছেন দেশে। অন্যদিকে কাঁচামাল আমদানির পর দেশে প্রক্রিয়াজাত করে বিপণন করা কীটনাশকের মান অনেক সময় ঠিক থাকছে না। এ ছাড়া একটি অসাধু সিন্ডিকেট নকল কীটনাশক তৈরি করে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বৈধ কোম্পানির কীটনাশকের দামও বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। ফলে উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেকই খরচ হয়ে যাচ্ছে কীটনাশকের পেছনে। অথচ বালাইনাশকের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবসা থামাতে নেই ফলপ্রসূ উদ্যোগ।
দোকান পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তাকে মাসে অন্তত দুটি নমুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ে (প্লান্ট প্রটেকশন) পাঠানোর কথা বলা হলেও সে নিয়মের পথে হাঁটছেন না অনেকে। আবার নমুনা পাঠালেও পরীক্ষাগারের প্রতিবেদন পেতে দু-তিন মাস সময় লেগে যাওয়ায় যথাসময়ে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফসল আবাদের পরিধি ও ধরন বদলে গেছে। বেড়েছে ফসলের জন্য ক্ষতিকর রোগজীবাণু ও কীটপতঙ্গ। এসব দমনে কৃষক বালাইনাশকের ব্যবহারও বাড়িয়েছেন। আর এই সুযোগে কোম্পানিগুলো কাটছে কৃষকের পকেট। কৃষিতে কীটনাশক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে শক্ত নজরদারি দরকার বলে মনে করেন তারা।
৯৮ শতাংশই আমদানিনির্ভর
বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিপিএ) তথ্য বলছে, দেশে বালাইনাশকের পাঁচ হাজার কোটি টাকার বাজার। দানাদার বাদে তরল ও গুঁড়া বালাইনাশকের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। মূলত দেশে একচেটিয়া ব্যবসা করছে আটটি বহুজাতিক কোম্পানি। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সিনজেন্টা। এসব কোম্পানি প্রায় দুই হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করছে, আর স্থানীয় ৬৯৩টি আমদানিকারক কোম্পানি ব্যবসা করছে দুই হাজার ১৫০ কোটি টাকার; যা মোট ব্যবসার ৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে মাত্র ১০০ কোটি টাকা কিংবা মোট বাজারমূল্যের ২ শতাংশ ব্যবসা করছে দেশীয় ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে চার হাজার টন বালাইনাশকের ব্যবহার ছিল; ১৯৮০ সালে তা ছিল পাঁচ হাজার টন। ২০০০ সালে তা আট হাজার টনে দাঁড়ায়। প্রায় দুই দশকের ব্যবধানে (২০২২ সালের হিসাব) বালাইনাশকের ব্যবহার অস্বাভাবিক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার টনে। ২০০০ সালে দেশে বালাইনাশক ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ছিল আটটি। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩-এ। অর্থাৎ ২২ বছরে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বেড়েছে মাত্র ১৫টি। তবে ২২ বছরে স্থানীয় আমদানিকারকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৫০ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ সালে দেশীয় আমদানিকারকের সংখ্যা ছিল যেখানে ২০০, বর্তমানে এ সংখ্যা ৭০০।
নেই নজরদারি
পেস্টিসাইড আইনে রেজিস্ট্রেশন সনদে যে দেশ ও কোম্পানির নাম উল্লেখ থাকে, সেখান থেকেই নিবন্ধিত বালাইনাশক আনার নিয়ম রয়েছে। তবে এ আইন মানছেন না অনেকেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর এক ব্যবসায়ী বলেন, অনেকে আছেন একটি ঘোষণা দিয়ে আরেকটি (বালাইনাশক) নিয়ে আসছেন। বিদেশ থেকে মানহীন, সস্তা বালাইনাশক আনছেন কেউ কেউ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং আমদানির অনুমতি দিলেও বন্দরগুলোতে তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই কীটনাশক ঢুকিয়ে দেয়।
নির্দিষ্ট ছকে প্রতি মাসে বালাইনাশক দোকান পরিদর্শনের সংখ্যা, নমুনা সংখ্যা, ভুলত্রুটি, অনিয়ম, পদক্ষেপসহ প্রতিবেদন পাঠাতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাঠ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৮ সালে নির্দেশনাটি জারির পর খামারবাড়িতে নিয়মিত নমুনা পাঠাচ্ছিলেন তারা। তবে পরীক্ষা প্রতিবেদন আসতে দু-তিন মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এতদিনে মৌসুমই শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, দেশে নতুন নতুন কোম্পানি বালাইনাশক নিয়ে হাজির হচ্ছে। তারা মাঠ পর্যায়ের ডিলারদের বেশি কমিশন দিয়ে প্রলুব্ধ করছে। ডিলাররা বেশি কমিশনে এসব পণ্য কৃষকের হাতে তুলে দিচ্ছেন। উপজেলার সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা ভেজালবিরোধী কার্যক্রমে সক্রিয় থাকলেও বিভিন্ন কারণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
উৎপাদন খরচের অর্ধেকই কীটনাশকের পেছনে
নাটোর সদরের বাঙ্গাবাড়িয়া গ্রামে এক বিঘা জমিতে বেগুনের আবাদ করেছেন কৃষক শামীম হোসেন। জমিতে নিয়ম করেই কীটনাশক দেন। তার পরও শঙ্কায় থাকতে হয়, ভেজাল কীটনাশকের কারণে বিফলে যেতে পারে শ্রম আর অর্থ। তিনি বলেন, এক বিঘা জমিতে বেগুন চাষে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। বর্গা জমি হলে এর সঙ্গে যোগ হয় আরো ২০ হাজার টাকা। আর এই উৎপাদন খরচের অর্ধেকই কীটনাশকের পেছনে খরচ হয়।
এদিকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসল কোম্পানির মনোগ্রামসহ নকল কীটনাশক বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। কুষ্টিয়ার মিরপুরে বিআরপি অ্যাগ্রো কোম্পানি নামিদামি কোম্পানির মোড়ক লাগিয়ে ভেজাল কীটনাশক তৈরি করে। এই কোম্পানির মতো দেশে আরো পাঁচ শতাধিক নকল কোম্পানি ভেজাল কীটনাশক বিক্রি করে বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
কৃষি অফিসের কীটনাশক নিবন্ধনের ১৬ শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শর্ত হলো, নিবন্ধন পাওয়া ডিলাররা সরকারি অনুমোদিত কোম্পানি ছাড়া কীটনাশক বিক্রি করতে পারবে না। কেউ শর্ত ভাঙলে তার নিবন্ধন বাতিল বলে গণ্য হবে। তবে এ শর্ত মানছেন না ডিলাররা।
নীলফামারীর ডিমলার কৃষক সলেমান আলী বলেন, ‘আমরা তো দোকান থেকে বিশ্বাসের ওপর কীটনাশক কিনি। জমিতে ব্যবহারের পর বোঝা যায়, কীটনাশক আসল না নকল!’
লালমনিরহাটের আদিতমারীর কমলাবাড়ী ও বড়াবাড়ী গ্রামের কৃষকরা জানান, গত বছর তারা ফেয়ার অ্যাগ্রোকেমিক্যালস সার্ভিস লিমিটেডের বিক্রয় প্রতিনিধি ও ডিলারের পরামর্শে মেনকোজেব কীটনাশক স্প্রে করেছিলেন। এর দুই দিন পর আলুগাছের পাতা মরতে শুরু করে। তারা যোগাযোগ করলে ওই কোম্পানির প্রতিনিধি তাদের উৎপাদিত অন্য একটি ওষুধ স্প্রে করার পরামর্শ দেন; তবু শেষ রক্ষা হয়নি।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরের পূর্বচরবাটা গ্রামের চাষি অজি উল্যাহ বলেন, ‘আমরা এক কীটনাশক চাই, আর দোকানদার অন্য কীটনাশক দেয়। আগে ১০ দিন পর পর ওষুধ দিলে কাজ হতো। আর এখন চার দিন পর পর ওষুধ দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।’
সুনামগঞ্জের মধ্যনগরের সাড়ারকোনা গ্রামের কৃষক অজিত সরকার এবার ৫০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন। তিনি বলেন, ‘সিনজেন্টার এক প্যাকেট কীটনাশকের গত বছর দাম ছিল ২০০ টাকা, এখন কিনতে হচ্ছে ৩২০ টাকায়। খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানের শঙ্কায় আছি।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এমদাদুল হক মিয়ান বলেন, অনুমোদিত লেবেল ব্যবহার ছাড়া কোনো বালাইনাশক মজুদ কিংবা বিক্রি করা যাবে না। অভিযোগ পেলেই অভিযান চালানো হচ্ছে। কোনোভাবে ভেজাল কীটনাশক বিক্রি করতে দেওয়া যাবে না।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনুকূল আবহাওয়া না থাকা, কীটপতঙ্গের টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়া ও ভেজালের কারণে কীটনাশক প্রয়োগ করেও ফল পাচ্ছেন না কৃষক। এ অবস্থায় জৈব বালাইনাশক ব্যবহার বাড়াতে হবে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh