ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ডেভিলস ব্রেথ

ধরুন নির্জন কোনো রাস্তা দিয়ে আপনি কোথাও যাচ্ছেন। হঠাৎ অপরিচিত কেউ এসে আপনার সামনে একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে কোনো ঠিকানা জানতে চাইল। স্বাভাবিকভাবে আপনি কাগজটি ধরে ঠিকানাটি পড়ে দেখতে চাইবেন। আর এই সুযোগটাই নেবে সেই ব্যক্তিটি। আপনি বুঝতেও পারবেন না, সামান্য এই কাগজটিতে লুকিয়ে আছে এমন এক রাসায়নিক, যা আপনার জীবনকে মুহূর্তেই বিপন্ন করে তুলতে পারে। কাগজে আগে থেকে মেশানো এক ধরনের ড্রাগের প্রভাবের কারণে নিমিষেই আপনি অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়বেন। হারিয়ে ফেলবেন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ। এ অবস্থায় আপনার সামনের ব্যক্তিটি আপনাকে যা বলবে আপনি তাই মেনে নিতে বাধ্য হবেন। 

বলছিলাম ভয়ংকর ড্রাগ স্কোপোলামিনের কথা। অপরাধ জগতে যা ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস নামে পরিচিত। এটি এতটাই ভয়ংকর ড্রাগ, যা মানুষের স্মৃতিশক্তি, চিন্তা করার ক্ষমতা এমনকি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণও নষ্ট করে দেয়। যারা এই ড্রাগের প্রভাবে পড়ে, তারা আক্রমণকারীর আদেশ মেনে চলতে বাধ্য হয়, যেন কোনো যান্ত্রিক পুতুল। স্কোপোলামিন ব্যবহার করে অপরাধীরা মানুষের সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে পারে। এমনকি এর মাধ্যমে খুনের মতো অপরাধ করানোও সম্ভব।

স্কোপোলামিনের উৎপত্তি মূলত কলম্বিয়ায়। ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম জার্মানির বিজ্ঞানী আলবার্ট লাদেনবার্গ সত্যের সন্ধানে এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯২২ সালে এটি কারাবন্দিদের ওপর প্রয়োগ করা হয়। স্কোপোলামিনকে ধরা হয় প্রথম ‘ট্রুথ সেরাম’ বা সত্য বলানোর ওষুধগুলোর একটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যবহৃত করত। তখন এর ব্যবহার হতো লিকুইড হিসেবে, ইনজেকশনের মাধ্যমে- শত্রুপক্ষের কাছ থেকে গোপন তথ্য বের করার কাজে।

স্কোপোলামিন একটি প্রাকৃতিক ট্রপেন অ্যালকালয়েড, যা নাইটশেড পরিবারভুক্ত গাছপালা, যেমন ধুতুরা ও ব্রুগমেনসিয়ার বীজ থেকে প্রাপ্ত। এটির বৈজ্ঞানিক নাম হায়োসিসিন ছাড়াও আরো কয়েকটি নাম রয়েছে, যার মধ্যে বুরুন্ডাঙ্গা, কলম্বিয়ান ডেভিলস ব্রিথ, রোবট ড্রাগ বা জম্বি ড্রাগ উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিকভাবে এটি বিভিন্ন চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো। মোশন সিকনেস, অপারেশন-পরবর্তী বমি বমি ভাব এবং পারকিনসন রোগের কাঁপুনি প্রশমনে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত। তবে এটা প্রাকৃতিক কোনো উপাদান নয়। বরং প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে কৃত্রিমভাবে স্কোপোলামিন তৈরি করা হয়। এটা তরল ও পাউডার দুই রূপেই পাওয়া যায়।

স্কোপোলামিন অপরাধীদের কাছে একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি ভিজিটিং কার্ড, কাগজ, কাপড় এমনকি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। স্কোপোলামিনের গুঁড়াটি নাকের চার থেকে ছয় ইঞ্চির মধ্যে এলে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এটি কাজ শুরু করে। আক্রান্ত ব্যক্তি তার চারপাশ সম্পর্কে অসচেতন হয়ে পড়ে এবং আক্রমণকারীর নির্দেশনা মেনে চলে।  

এটি প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাথমিক স্মৃতিকে ব্লক করে দেয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি আক্রমণকারীর নির্দেশ অন্ধভাবে মেনে চলে। এটি মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি এবং প্রতিরোধ ক্ষমতাও বন্ধ করে দেয়।  

যেমন ধরুন, একজন আক্রান্ত ব্যক্তি আক্রমণকারীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও সে তাকে চিনতে পারবে না বা তার প্রতি কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। এই অবস্থায় আক্রমণকারী যা বলবে, আক্রান্ত ব্যক্তি তা-ই করবে।  স্কোপোলামিনের প্রভাবে ভুক্তভোগী সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়ে। কেউ কেউ এক ঘণ্টার মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে, আবার কারো ক্ষেত্রে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগে।  

অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, স্কোপোলামিন বা শয়তানের শ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথ হিসেবে পরিচিত পাওয়া এই মাদক মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ফলে শরীরে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না বা বাইরের কোনো আক্রমণে শরীর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর মতো অবস্থায় থাকে না। এ অবস্থায় ভিক্টিমের আচরণ হয়ে যায় বশীভূত বা সুতায় বাঁধা পুতুলের মতো। তারা নিজে কিছু চিন্তা করতে পারেন না, শুধু সামনের লোক যা বলবে তাই করেন রোবটের মতো। ফলে দুর্বৃত্তরা লোকজনকে সর্বস্বান্ত করতে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে স্কোপোলামিনকে। 

কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, পেরু এবং চিলির মতো দেশগুলোতে এই ড্রাগ যৌন অপরাধ, চুরি ও প্রতারণার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি এটি পর্নোগ্রাফি তৈরি বা জোরপূর্বক নগ্ন ছবি তোলার জন্যও ব্যবহৃত হয়।  

বাংলাদেশেও সম্প্রতি স্কোপোলামিনের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। শুরুতে ঢাকায় পাওয়া গেলেও পরবর্তী সময়ে যশোর, খুলনা, রাজবাড়ী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্কোপোলামিন ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। 

নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি চক্রের কাছ থেকে প্রথম ১০ গ্রাম স্কোপোলামিন উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ থানা পুলিশ। চক্রটি অনলাইন গ্রুপের মাধ্যমে স্কোপোলামিন, পটাশিয়াম সায়ানাইড ও ক্লোরোফর্ম বিক্রি করত।

পুলিশের কাছে স্কোপোলামিন সম্পর্কিত অপরাধের সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবে তারা স্থানীয় অপরাধীদের সঙ্গে কিছু ইরানি নাগরিকের জড়িত থাকার খোঁজ পেয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, স্কোপোলামিনসহ বেশ কিছু রাসায়নিক মাদক চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। কুরিয়ার সার্ভিস বা ওষুধের কাঁচামালের আড়ালে এগুলো প্রবেশ করছে দেশে।  

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে স্কোপোলামিন মাদকের তালিকায় নেই। এটি মাদক হিসেবেও বিবেচিত নয়, কারণ এটি সরাসরি নেশার জন্য ব্যবহৃত হয় না। তবে এর ভয়াবহ প্রভাবের কারণে এটি মাদকের চেয়েও ভয়ংকর।  

স্কোপোলামিন একটি রহস্যময় ও বিপজ্জনক রাসায়নিক। এর প্রভাব শুধু ব্যক্তির জীবনের ওপর নয়, পুরো সমাজের ওপরও পড়ছে। এটি অপরাধীদের হাতে এক মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা মানুষের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এর থেকে রক্ষা পেতে অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু না নেওয়া; অপরিচিতকে গা ঘেঁষতে না দেওয়া এবং অপরিচিত কেউ কিছু পড়তে দিলে তা না পড়ার পরামর্শ অপরাধ বিশেষজ্ঞদের। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কোপোলামিনের অপব্যবহার প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকর ভূমিকা ছাড়া এই ভয়ংকর ড্রাগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh