অপরাধবোধের গল্প

কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই পেশাগত দায়িত্বে ভীষণ রকমের একটিভ ছিলাম। ঘুম নেই, খাওয়া নেই, নিজের কথা চিন্তা করার সময় পাইনি, অমানবিক নিষ্ঠুর হয়েছিলাম নিজের প্রতি। চোখের সামনে পাখির মতো মানুষকে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছি। এতটাই মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলাম যে রাতে ঘুমটাও ঠিকঠাক হতো না।

আরো বেশি ভয় পেয়েছিলাম কিছু মানুষ না বুঝেই সাংবাদিক পেটানো শুরু করল। একদিকে আন্দোলনকারীরা হামলা করছে, অন্যদিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মী ও ক্ষমতাসীনরাও আমাদের খুঁজে খুঁজে পেটাতে শুরু করল। যেখানে যাই সেখানেই হামলার শিকার হচ্ছিলাম। খুব বেশি সতর্কতার সঙ্গে নিজের জীবন রক্ষা করে কাজ করার চেষ্টা করছিলাম। ছয় দিনের মতো বাসার বাইরে পালিয়ে ছিলাম। এক কাপড়ে কাটিয়ে দিলাম ওই কয়টা দিন। রাতে টি-শার্ট ধুয়ে সকালে পরে বের হতাম। 

১৮ জুলাই শুক্রবার আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রতিদিনের মতো ক্যামেরা হাতে ছুটলাম, জানি না আজকে বেঁচে ফিরতে পারব কি না, সবটাই ভাগ্যের উপর নির্ভর করছে। কিছু দূরে আসার পর গুলির শব্দ শুনতে পেলাম, মনে হচ্ছে আশপাশে কোথাও যুদ্ধ চলছে। বাইকের গতি বাড়িয়ে দ্রুত ছুটে চললাম। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে আসার পর বুঝলাম গুলির শব্দ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির দিক থেকে আসছে। বাইকটা একটি গলির ভেতরে রেখে বাড্ডার রাস্তা ধরে সেদিকে এগোতেই দেখি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার ভয়ংকর সংঘর্ষ চলছে। পুলিশের গুলিতে একেক করে মানুষ গুলিবিদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ভয় না পেয়ে গুলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে পুলিশকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। চোখের সামনে একটা বাচ্চার মাথায় গুলি লাগল, বাচ্চাটা রাস্তায় রাস্তায় দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে, ওর মাথা বেয়ে চোখের নিচ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে চোখের জলের ফোঁটার মতো, কিন্তু ১৪-১৫ বছরের বাচ্চা ছেলেটি তখনো হয়তো খেয়াল করেনি ওর মাথায় লাগা গুলিতে রক্তে ভিজে যাচ্ছে মুখ। কিছু মানুষ তুলে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ছুটে গেল, তারপর আসলেই জানা হয়নি ওর মৃত্যু বা বেঁচে থাকার খবর। হঠাৎ খেয়াল করলাম মধ্য বয়স্ক একজন মানুষকে চার-পাঁচজন হাত-পা ধরে নিয়ে আসছে। সাদা শার্ট পরা ভদ্রলোকের বুকে গুলি লেগেছে। সাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে আছে, আমি ছবি তুলছি। আমার কাজ শুধু ছবি তোলা এবং পেশাগত দায়িত্ব পালন করা। তাই করছি এত কিছু চিন্তা না করে।  সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের গুলি চলছে। একটা সময় পর তাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে ছাত্র-জনতা পুলিশকে ধাওয়া দিল, ভয় পেয়ে তারা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পাশের একটা বিল্ডিংয়ের ভেতরে আশ্রয় নিল। 

এরপর আমি চলে এলাম রামপুরা টিভি সেন্টারের সামনে। ওই দিক থেকে পুলিশ একের পর এক গুলি করছে, অসংখ্য ছেলেমেয়ে গুলিতে আহত হচ্ছে, আমি শুধু ছবি তুলে যাচ্ছি। সকাল থেকে দুপুর হলো, পুলিশের গুলি চলছে। আমরা পুলিশের পেছনে আশ্রয় নিলাম গায়ে গুলি লাগবে এই ভয়ে। মাথার ওপর রোদ, ভয়ংকর গরম। শরীর আর চলে না। 

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বারবার আমাদের উদ্দেশে বলছে, আপনারা কেন নিউজ করেন না? আপনারা দালাল সাংবাদিক! তখন নিজেদের ভীষণ রকমের অসহায় মনে হচ্ছে। কাউকে কোনো কথার উত্তর দিচ্ছি না, নীরবে নিজের কাজটা করে যাচ্ছি। একসময় ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাতিরঝিলে ঢোকার মুখে রেস্ট করছিলাম কিছু সহকর্মীর সঙ্গে। হঠাৎ আবারও পুলিশের গুলি, একদল পুলিশ আমাদের দিকে ছুটে আসছে। বুঝলাম, পুলিশ গুলি করতে পারে। হাত উঠিয়ে তাদের উদ্দেশে বললাম, এখানে সবাই সাংবাদিক, কেউ গুলি চালাবেন না। কথা শেষ না হতেই আমাদের দিকে গুলি ছুড়ল। আমার গায়ে গুলি লাগে, ওই অবস্থায় দৌড়ে পালিয়ে হাতিরঝিলের ফুটপাতে বসে পড়লাম।  তারপর আমাদের এক বড় ভাই ও সহকর্মী ছুটে এলো। এ সময় ছাত্ররা এসে বলে, আপনারা কেন কাজ করছেন না, সত্যি খবর প্রকাশ করেন না, আপনাদের পেটানো উচিত। তখন সবাই মিলে বুঝিয়ে বলল, ভাইয়া আপনাদের মতো আমরাও আহত, আমাদের গায়েও গুলি লেগেছে, কি করব বলেন? এরপর তারা শান্ত হলো। 

আমি ঢাকা মেডিক্যাল গেলাম চিকিৎসা নিতে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দাঁড়ানোর জায়গা নেই, একের পর এক গুলিবিদ্ধ মানুষ আসছে জরুরি বিভাগে। হাসপাতাল যেন এক মৃত্যুপুরি। চারপাশে মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে উঠল বাতাস। কারো পায়ে গুলি, কারো মাথায় গুলি, সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। বুঝলাম এখানে আমার এই সাধারণ চিকিৎসা হবে না। আমাকে ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে বললেন, আপনি চলে যান। আমি চলে গেলাম আনোয়ার খান মেডিক্যালে। সেখান থেকে প্রাথমিক  চিকিৎসা নিয়ে অফিসে ফিরে আসি। সন্ধ্যার পর খবর এলো, ঢাকা মেডিক্যালের অবস্থা ভালো নয়। শোনামাত্র ছুটে গেলাম জরুরি বিভাগের সামনে। গিয়ে দেখি এ যেন অন্য মেডিক্যাল, এ রকম কিছু দেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি ছিলাম না। হাত-পা কাঁপছে হাসপাতালের বাইরের চিত্র দেখে। দু-এক মিনিট পরপরই আহত গুলিবিদ্ধ মানুষ আসছে। মনে হলো আমি যেন সিরিয়ার যুদ্ধ দেখছি, ছবি তোলার মতো সাহস হচ্ছে না। স্কুল ড্রেস পরা একটা ছেলে আমার দিকে ছুটে এলো তার সাদা শার্ট রক্তে ভিজে গেছে। একটি রক্তমাখা আইডি কার্ড দেখিয়ে বলছে, ভাই আমার বন্ধু আমার কোলের ওপর মরে গেছে, আমি কিছু করতে পারিনি। ভাই আমার বন্ধুকে পুলিশ বুকের উপরে গুলি করে মারছে। আপনারা সাংবাদিকরা প্লিজ একটু ভেতরে যান, আমার বন্ধুর মতো অসংখ্য লাশ পড়ে আছে। আহত অনেকে চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। আমি আর কিছু বলতে পারছি না।

তখন পাশে একজন পুলিশ সদস্য দাঁড়ানো, তার কোমরে রাখা পিস্তলে হাত। আমি পুলিশের কাছে গিয়ে বললাম, গুলি করবেন? করেন গুলি, আপনারা তো গুলি ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না। পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনল, কোনো কথা নেই। ছেলেটি বন্ধুর লাশ নিয়ে ছুটে চলল। আমার চোখ ভিজে উঠছে। ভাবছি, মানুষের জীবনের দাম ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি। 

জরুরি বিভাগের সামনে রক্তের জন্য হাহাকার, ইন্টারনেট বন্ধ, রক্ত ম্যানেজ করা সম্ভব হচ্ছে না। কেউ কেউ রক্ত দেওয়ার জন্য লাইন দিচ্ছে, কিন্তু এত রক্ত কোথায় পাবে? যত রোগী আসছে সবার অবস্থাই খারাপ। হঠাৎ খেয়াল করলাম, রক্ত শরীরে একজনকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে, তার কপালের ভেতর ছুরি ঢুকানো, মাথা বেয়ে রক্তে শরীর ভিজে গেছে। এটা দেখার পর আমি একটাও ছবি তোলার সাহস পেলাম না। 

এত লাশ মানুষ আর নিতে পারছে না। হঠাৎ এক বড় ভাই এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, প্রিয়কে চেনেন? উদ্যানের গেটে আড্ডা মারে ছেলেটা, কিছু সময় আগে গুলি খাইছে। তার লাশ খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কি তার লাশটা দেখছেন?  কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, না ভাই, লাশটা আমার চোখে পড়েনি। আমি জানি না, আমার মানুষ হিসেবে কী করা উচিত? সব বাদ দিয়ে লাশটা খুঁজব? কিন্তু মানুষটিকে এখনো আমি চিনে উঠতে পারছি না, কেন পারছি না? নাকি আমি না চেনার ভাণ করে লাশটা না চেনার ভয়ে মিথ্যা বলছি? আমার কি কান্না করা উচিত, নাকি ছবি তুলব, নিজেকে ধরে রাখা বেশ কঠিন কাজ। এত এত মানুষের কান্না, কোনোভাবে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না। ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের সামনে বেশ কিছু পুলিশ দাঁড়ানো। আমি চিৎকার করে পুলিশকে উদ্দেশ করে বললাম, ভাই বাংলাদেশে কি এমন ঘটনা ঘটছে, যার জন্য এত এত মানুষকে গুলি করতে হবে? পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে চিৎকার  শুনল, মুখে কোনো শব্দ নেই।

অফিসে সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক। আমাদের চিপ রিপোর্টার আমাকে দেখে বললেন, কত দিন ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেন না, জামা-কাপড় ময়লা ক্যান? উত্তরে আমি বললাম, ভাই এখনো বেঁচে আছি-এ জন্য খুশি থাকেন, প্রতিদিন যে লাশ দেখছেন সেই লাশের মধ্যে আমাকেও পেতে পারেন।

সরকার সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। যেহেতু আমি ফটোগ্রাফার, পাশাপাশি বিদেশি দুইটা গণমাধ্যমে কাজ করি, প্রতি মুহূর্তের ছবি আমাকে অফিসে ই-মেইল করতে হয়। আমরা সবাই বিপদে পড়ে গেলাম কীভাবে ছবি-নিউজ পাঠাতে পারি? পুরো পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ইন্টারনেট না থাকার কারণে কোনো ছবি পাঠাতে পারছি না। হঠাৎ করে সন্ধ্যায় বিদেশি একটা নম্বর থেকে কল এলো, আমার সুইডেন অফিসের বসের। জানতে চাইলাম, কীভাবে ছবি পাঠাব? তখন তিনি এএফপির শফিক ভাইয়ের কথা বললেন, যিনি আমার জন্য ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করবেন। 

আমি সন্ধ্যার পরে আফতাবনগরে শফিক ভাইয়ের অফিসে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি সেখানে আরেক চিত্র। বিদেশি গণমাধ্যমে কর্মরত আরো অনেকে সেখানে তাদের ছবি পাঠানোর জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের সবার চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, সঙ্গে আতঙ্ক। 

৪ আগস্ট, সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম, পরিস্থিতি খুবই ভয়ংকর। এক ঘণ্টার মতো দাঁড়িয়ে আছি বাংলামোটর গলির ভেতরে, কারণ ছবি তুলতে গেলেই নিজের গায়ে গুলি লাগার অপার আশঙ্কা। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছে, ভাই ওদিকে আওয়ামী লীগের লোকজন গুলি করছে আমাদের উপর, আপনারা সামনে যান। ছবি তুলে প্রকাশ করুন।

নিজেও খানিকটা বোঝার চেষ্টা করলাম আসলেই কে গুলি করছে? তারপর একটু একটু করে সামনে গিয়ে দেখি পুলিশের পাশাপাশি গুলি করছে ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের সব সন্ত্রাসী বাহিনী। তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ হচ্ছে। কী যে ভয়াবহ পরিস্থিতি! 

আমরা চার-পাঁচজন কারওয়ান বাজারের অলিগলির মধ্য দিয়ে ফার্মগেট গেলাম। দেখলাম একদল পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক দূরে, পুলিশের গুলিও চলছে না। এটুকু বুঝতে পারছি, তারা কিছু একটা ঘটাচ্ছে। আমি পুলিশের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে চাইলাম, হঠাৎ তিন-চারজন পুলিশ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ওইখানে যাওয়া যাবে না। ছাত্ররা গুলি করছে ওপাশ থেকে, আপনি গেলে গায়ে গুলি লাগবে। 

আমি তাকে বললাম, আপনি আমাকে কোনোভাবে বাঁধা দিতে পারেন না। সেই অধিকার আপনাদের নেই, আমি আমার পেশাগত দায়িত্ব পালন করব, আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেন। আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

কথাটা শেষ না হতেই দেখলাম পাশ থেকে একটা রিকশা ওই ভিড়ের দিকে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আমার আরো সন্দেহ হলো, কেন যেতে দিচ্ছে না? হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম চার হাত-পা ধরে রক্তাক্ত অবস্থায় নিথর দেহ একজন মানুষকে রিকশায় উঠিয়ে দিচ্ছে। রিকশার পাদানির নিচে কোনো রকম ফেলে রেখে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার কপালে জাতীয় পতাকা বাঁধা, তখনো বেঁচে আছে। ছেলেটা নিভু নিভু অসহায় চোখে আমার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে শুরু করি। পুলিশ বারবার বাধা দিচ্ছে, কিন্তু আমি তো কথা শোনার মানুষ না। রিকশাটা আল-রাজি হাসপাতালের দিকে নিয়ে গেল। হাসপাতালের গেটের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৪০ থেকে ৫০ জন আওয়ামী লীগ নেতা রিকশা ঘিরে ধরল। ছেলেটাকে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে দিল না। 

আমি তখনো ছবি তুলে যাচ্ছি। হঠাৎ ওদের মধ্যে একজন আমাকে খেয়াল করল। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা নামিয়ে চুপচাপ অন্যদিকে হাঁটা শুরু করলাম, কিন্তু চার-পাঁচজন ডাক দিল। জিজ্ঞেস করল, তুই ছবি তুলেছিস? আমি ভয়ে বললাম, ভাই ছবি তুলি নাই পুলিশের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। 

তখন কে কার কথা শোনে, ওরা আমার ক্যামেরা চেক করল। আমি একটু বুদ্ধি করে আগের ছবি দেখিয়ে বললাম, ভাই দেখেন আপনাদের ছবি তুলি নাই। ঠিক পাশে আমার আরেকজন সহকর্মীকে রড দিয়ে পায়ে বাড়ি মারল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা চিৎকার দিয়ে উঠল। আরেকজন তার অ-কোষে লাথি মারল। ছেলেটা ব্যথায় বসে পড়ল রাস্তায়। ওদের হাত-পা ধরে কোনো রকমে আমরা চারজন মিলে সহকর্মীকে টেনে নিয়ে দৌড় দিয়ে অফিসের সিঁড়ির নিচে পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। 

ছবিটা পত্রিকায় ছাপিয়ে দিলাম কোনো ধরনের ভয় ছাড়া। রাত ১২টার পর ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ছবি দেখে পরিবারের লোকজন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে লাশ খুঁজে পায়। 

ঘটনার দুই দিন পর তার বাবা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। জানতে চায় তার ছেলেটা তখনো বেঁচে ছিল কি না। ডাক্তার বলেছেন, গুলি ছেলেটার বুক ভেদ করে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি তাকে বলতে পারিনি ‘আপনার ছেলে তখনো বেঁচে ছিল!’ এই সাহস আমার হয়নি। ভয়ংকর এক অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে। আমি তার বাবাকে মিথ্যা বলছিলাম, আপনার ছেলে বেঁচে ছিল কি না তা খেয়াল করিনি। 

ভয়ংকর এক মানসিক যন্ত্রণা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি এখনো দেখতে পাই ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমার কাছে সাহায্য চাইছিল, কিন্তু আমি পারিনি বাঁচাতে। এ রকম আরো শত শত অপরাধবোধের গল্প থাকে একেকটা সহিংসতার ছবির পেছনে। সেসব নিয়ে আমি ও আমরা বেঁচে থাকি মৃত্যুর কাছাকাছি। না পারি প্রাণভরে আনন্দে বাঁচতে আর না পারি বাঁচতে চাওয়া মানুষগুলোকে বাঁচাতে। ইতিহাসে লেখা থাকে না সেসব পেছনের গল্প। 

যন্ত্রণা হচ্ছে খুব বুকের ভেতর। পৃথিবীটা মানুষের হোক, ক্ষোভ, লোভ আর হিংসা মুক্ত একটা দেশ তৈরি হোক। সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানুষ আগে মানবিক হোক। নৈতিকতার সংস্কার হোক। এই আশায় আবারও বাঁধি বুক।

লেখক : আলোকচিত্র শিল্পী

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh