বিপ্লব আমাদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার আগে থেকেই আমি রাজনীতিতে সক্রিয়। একসময় ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হই। তবে ২০২৩-এর জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি থেকে আমি, আসিফ ভাইসহ যারা ছিলাম পদত্যাগ করে নতুন একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ নিই- ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’।  ওই সময় মাহফুজ ভাই ও নাহিদ ভাইয়ের উদ্যোগে পরিচালিত ক্যাম্পাসের বুদ্ধিবৃত্তিক পাঠচক্রের একটি অংশ এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের বিদ্রোহী অংশ- একসঙ্গে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ গঠন করি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেছি। ছাত্রশক্তি এখন স্থগিত রাখা হয়েছে। 

জুলাই মুভমেন্টে আমার যুক্ত হওয়া ১৪ জুলাই। আন্দোলনের যদি দুটি ভাগ ধরি তাহলে শেখ হাসিনা যখন রাজাকার বলে ডাকলেন, তার আগপর্যন্ত এটা ছিল স্রেফ একটা কোটা সংস্কার আন্দোলন, তারপর সেটা হয়ে গেছে আত্মমর্যাদা রক্ষার একটা আন্দোলন। এরপর সেখান থেকে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা রক্ষা এবং স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। ১৪ জুলাইয়ের আগপর্যন্ত শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমি আন্দোলনে ছিলাম না, কিন্তু এরপর আর বসেও থাকা সম্ভব ছিল না। সেদিন রাতে ক্যাম্পাসে যখন মিছিল নিয়ে হল থেকে সবাই বেরিয়ে পড়ল এবং স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান দিল, তখন আমি বুঝে গেলাম ‘দিস ইজ দ্য টাইম। দিস ইজ আওয়ার টাইম’। 

১৫ তারিখ মাঠে নামলাম, শহীদুল্লাহ হলের সামনে ছাত্রলীগের সঙ্গে কয়েক দফা সংঘর্ষেও জড়ালাম, কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আহত হলো। ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে শহীদ মিনারে ১৬ জুলাই বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাসা থেকে বের হলাম। ফোনে আমাদের নেতা আখতার ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার সঙ্গে একত্রিত হই। আসিফ ভাই ও নাহিদ ভাই শহীদুল্লাহ হলের সামনে জমায়েতের কাজ করছিলেন, ওনারা মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারের সামনে আসবেন। আসিফ ভাইকে ফোন করলাম, তিনি বললেন, আখতার ভাইয়ের সঙ্গে থাকো, তাকে একা পেলে ছাত্রলীগ মেরে ফেলবে। আমি আর আখতার ভাই ঢাকা মেডিক্যালের বহির্বিভাগের গেটে অবস্থান নিয়েছিলাম। কিছুটা দূরে ২০ থেকে ২৫ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আগে থেকে অবস্থান করছিল- এই পরিস্থিতিতে ঢাকা মেডিক্যালের একটা মিছিল এলে আমরা তাদের সঙ্গে মিশে শহীদ মিনারে চলে আসি। 

১৬ তারিখে আমাদের মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ছাত্রলীগ হামলা করার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে এলেও সফল হয়নি। কারণ আমরা সংখ্যায় ছিলাম অনেক এবং প্রত্যেকের হাতে লাঠি। সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বের করে দেওয়ার ঘটনাটি ছিল আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। আমরা জানতাম না এ বিজয়টা কত দিন টিকবে, আমরা শুধু এটাই ভাবতাম যে, হোক না এক সপ্তাহের জন্য, মন্দ কি!

১৭ তারিখে শহীদদের জন্য ভিসি চত্বরে অনুষ্ঠিত গায়েবানা জানাজা আমিই পড়াই। এটি টিএসসিতে করার কথা থাকলেও হাজার-হাজার পুলিশ-বিজিবির উপস্থিতির ফলে সম্ভব হয়নি। গায়েবানা জানাজায় আসার সময় আখতার ভাইকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। গায়েবানা জানাজা পড়ানোর মুহূর্তটি আমার জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। 

১৭ তারিখের পর আমরা ক্যাম্পাস ছাড়া হলাম। সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বলল, ভাই আমি আপনার সঙ্গে থাকব। ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে আন্দোলনে অংশ নিলাম। ১৯ তারিখ মিরপুর-১০-এ আমার  এক চাচাতো ভাই শহীদ হন। তিনি হলেন শহীদ আসিফ ইকবাল। কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে সবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নাহিদ ভাই ও আসিফ ভাইয়ের কী হয়েছে, জানতাম না। আমরা একটা অফলাইন মেসেজগ্রুপ খুললাম, কে কোন এলাকায় আছি, আন্দোলনের কী পরিস্থিতি, গ্রুপে সবকিছু আপডেট দিতাম।

তিন দিন পর রিফাত আমার বাসা থেকে চলে যায়। তারপর তার খোঁজ পাইনি। এখন তো সকলেরই জানা রিফাত, হান্নান, মাসুদ আর মাহিনের সে সময়কার ভূমিকা। নাহিদ ভাই, আসিফ ভাইয়েরা যখন আটক হলেন, তখন রিফাত, হান্নান, মাসুদ সেফ সাইড না নিলে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ত। 

৫ আগস্ট নাহিদ ভাই সশস্ত্র বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে ভিডিও করে রেখেছিলেন। সেদিন সফল না হলে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে যাব এমন মানসিক প্রস্তুতি আমাদের ছিল। কিন্তু খুনিদের পালিয়ে যেতে দিয়ে আমাদের বিপ্লবকে থামিয়ে দেওয়া হলো। এ কাজটা কারা করেছে তা আমরা সকলেই জানি, আমাদের সেনাপ্রধানসহ অনেকেই এ জায়গায় ছিলেন। আমি তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। তিনি হয়তো চেয়েছেন রক্তপাত থামাতে, কিন্তু আমাদের বিপ্লব এ জায়গায় থেমে যায়। 

আন্দোলন সংগঠিত করার অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু বিপ্লব-পরবর্তী দেশ গঠন, সরকার গঠন- এ জায়গাগুলোতে আমরা ছিলাম আনকোরা। সময় যাওয়ার পর বুঝেছি কোথায় আমাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হলো, কী গেম খেলা হলো। আমরা সবাই মনে করি, বিপ্লব আমাদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। 

আমাদের যে স্টুডেন্টস ফোরাম, আন্দোলনের রূপরেখার জায়গায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা মাহফুজ ভাই রাখতেন। যদিও সিদ্ধান্ত গ্রহণ আলোচনার মাধ্যমে হতো। আন্দোলনের এক পর্যায়ে মাহফুজ ভাইয়ের বিষয়ে নিউজ হয়ে যায়, তখন মাহফুজ ভাইকে গা ঢাকা দিতে হয়। এক দফার ঘোষণায় মাহফুজ ভাইকে উপস্থিত থাকার জন্য আমরা জোর দিলাম, তাকে বললাম, ‘এক দফার ঘোষণায় আপনাকে আসতে হবে, না হলে হিস্ট্রি থেকে আপনি মুছে যাবেন।’ মাহফুজ ভাই আসলে মাঠের রাজনীতিক কখনোই ছিলেন না। খুব স্বাভাবিকভাবে ওনার নামটা সামনে চলে আসায় উনি বিব্রত ছিলেন। তবুও নাহিদ ভাই এক দফা ঘোষণা করে বক্তব্য দেওয়ার পরই মাহফুজ ভাই বক্তব্য দিলেন। একদফায় ওনার উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যে কারণে তিনি ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছেন। 

অভ্যুত্থান-পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে যদি বলতে যাই, পৃথিবীর বেশির ভাগ জায়গায় বিপ্লব করে গরিবরা আর ফল ভোগ করে ধনীরা। এটাই অনেকটা নিয়ম। বাংলাদেশে বা পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যতগুলো বিপ্লব হয়েছে, বেশির ভাগ বিপ্লবই একটি স্ট্রাকচারের মধ্য দিয়ে এসেছে। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের জায়গায় ছিল এটা আমরা মানি। যেমন- চীনা বিপ্লবের কথা উঠলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কথা আসবে। কিন্তু আমাদের বিপ্লবী কাঠামো ছিল না, আমরা খুবই স্বতঃস্ফূর্ত জায়গায় ছিলাম, যেখানে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে এসেছে। কাঠামো না থাকা  আমাদের বড় দুর্বলতা ছিল, এটা সত্যি। কিন্তু নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে থেকে গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কিছু করা যায়নি, ফলে স্বতঃস্ফূর্ততা আমাদের শক্তি ছিল।

অভ্যুত্থানের পর ছাত্ররা অনেকক্ষেত্রেই একতাবদ্ধভাবে কাজ করতে পারেনি, যে যার মতো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আওয়ামী লীগ, দুর্নীতি ঠেকানো ইত্যাদি অনেক কাজই করেছে। ফলে তাদের নানাভাবে বিতর্কিত ও দুর্বল করা সহজ হয়েছে। একই সময় রাজনৈতিক এবং এলিট মোড়লরা মানতে পারছিল না, যে গরিব বিপ্লবী ও মধ্যবিত্তরা রাষ্ট্রের ক্ষমতায় চলে যাচ্ছে। একটা মধ্যবিত্ত ছেলে এসে প্রশ্ন করবে এটা তারা মানতে পারছিল না, পারছে না। এলিটের ছেলে হলে কোনো সমস্যা ছিল না। একাত্তরের পর একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল, যারা ভারতে গিয়ে আরামে ৯ মাস কাটিয়েছে, তারাই এসে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়েছিল। পরিশেষে এই কথাই বলি, এটা আধাপাকা বিপ্লব, অর্থাৎ একটা ফল পাকার আগে গাছ থেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা ছাত্ররা যদি সংগঠিত হই, ঐক্যবদ্ধ হই তাহলে এ বিপ্লবকে পূর্ণতা দিতে পারব ইনশাআল্লাহ।

তারেক রেজা, কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh