সেদিন গণভবনের পাশাপাশি বঙ্গভবনও ঘেরাও করা প্রয়োজন ছিল

১৭ তারিখে আমাদের যখন হল থেকে বের করে দেওয়া হলো, আমরা ফিরে গেলাম। আমাদের আর কিছু করার ছিল না। আমাদের ভাবনা ছিল এমন- ‘যা হয়েছে তা তো দেশের মানুষ দেখেছে, এবার যদি জনগণ নেমে আসে তাহলে দেশের জন্য ভালো হবে, তা না হলে আমাদের আর কিছু করার নেই।’ আমরা দেখলাম, যাত্রাবাড়ী খুব দ্রুতই উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। তখন কিন্তু একেবারে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে এসেছিল। কারণ আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার দৃশ্যটি আমাকে যেভাবে ব্যথিত করেছে, তাদেরও করেছে। ওই ঘটনার পর থেকে যারা আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিল, তারাও বলা শুরু করেছিল, ‘যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না, বেশি হয়ে যাচ্ছে।’ তারাও একটা মৌন সমর্থন আন্দোলনের প্রতি রেখেছিল। অত্যাচার-অনাচারের একটা শেষ থাকে, জনগণ তার শেষ চেয়েছিল এবং ছাত্র-জনতাই জয়ী হয়েছে। 

আমরা দীর্ঘদিন একটা ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছি। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতন হবে কিংবা নতুন একটি বাংলাদেশের অভ্যুদয় হবে এটা আমার ধারণায় ছিল না। তবে একটা বিষয় জানতাম যে, কোনো একদিন স্বৈরাচারের অবসান ঘটবে এবং একটি নতুন বাংলাদেশ দেখতে পাব। কিন্তু প্রাপ্তির জায়গাটি দেখলে এটা স্পষ্ট যে আমরা যেমন চেয়েছিলাম তা হয়নি। প্রশাসনের মধ্যে শুধু চেহারার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রমের বদল হয়নি। পুরোনোদের জায়গায় যে নতুন ওসি, এসপি, ডিসি, ইউএনওরা যোগ দিয়েছেন, তারা খুব কমজনই নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছেন। বাকিরা ক্ষমতায় আসতে পারে এমন রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে একটা সিস্টেম দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে খুব বেশি নিরপেক্ষ লোক পাওয়া যায় না। ফলে পুলিশ ও প্রশাসনে এর প্রভাব পড়েছে। 

আমরা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের কথা বলেছি, কিন্তু জনগণের বিষয়টি ভিন্ন, তারা এত কিছু ভেবে আন্দোলনে নামেনি, জনগণ নেমেছে শেখ হাসিনার পতনের জন্য, তাদের অনেকেই ভেবেছে, শেখ হাসিনার পতনের পরই কাজটি শেষ। আসলে কাজ এখনো শেষ হয়নি। 

৫ আগস্টের বিজয় মিছিলের পর সাধারণ মানুষ কিন্তু ঘরে ফিরে গেছে। সব মানুষ তাদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড, পরিবার সবকিছু রেখে শুধু রাজনীতির জন্য সময় ব্যয় করবে, দেশের জন্য সময় দেবে- এটা কখনোই সম্ভব নয়। আবার এর মানে এটাও নয় যে, যারা সময় দিচ্ছে বা কাজ করছে, তাদের জনগণ সমর্থন করে না। আমরা মনে করি, আমাদের প্রতি জনগণের সমর্থন আছে। এই সমর্থনটা যদি দৃশ্যমান করতে হয় তাহলে আমাদের সাংগঠনিক কাজকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে। সে লক্ষ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কাজ করছে, যাতে করে আমরা প্রতিটি গ্রামে যেতে পারি। 

৫ আগস্ট আমাদের একটা ভুল হয়েছিল, সেদিন গণভবনের পাশাপাশি বঙ্গভবনও ঘেরাও করা প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করিয়ে ওই দিনই শহীদ মিনারে একটা বিপ্লবী সরকারের শপথ গ্রহণ সম্ভব হতো। সেদিন যদি আমরা বিপ্লবী সরকার গঠন করতে পারতাম তাহলে আজ আমাদের যে বাধাগুলো আসছে তা আসত না। বিপ্লব এখনো চলমান, কেন না আমরা এখনো মনে করি যে ১৯৭২-এর সংবিধান পুনর্লিখন জরুরি।

তবে এটাও সঠিক যে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হয়েছে, তা ১৭ বছরের গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবং এ সরকারে সর্বমহলের প্রতিনিধিত্ব আছে। সে জায়গা থেকে এই সরকারকে গণপ্রতিনিধিত্বশীলও বলা যায়। জনগণের রায়ের একমাত্র মাধ্যম যে নির্বাচন, তা আমি মনে করি না। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অবশ্যই রাজনৈতিক সরকারই আসবে, সে রাজনৈতিক সরকার যখন সংস্কারের দিকে যাবে তখন তারা তাদের রাজনৈতিক দিক থেকেই সংস্কারগুলো করবে। কিন্তু যখন একটা নিউট্রাল গভর্নমেন্ট ক্ষমতায় থাকবে তখন তারা জাতীয় সচেতনতার ভিত্তিতে বৃহৎ সংস্কারের চেষ্টা করবে, যেটা আসলেই দেশের জন্য দরকার। আমরা আরো মনে করি যে সংস্কার যতক্ষণ পর্যন্ত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচনের দিকে যাওয়াটা উচিত হবে না। যদি এখনই নির্বাচনের দিকে যায়, তাহলে এ অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রতিটি খাতে আমরা সংস্কার চাই। ১৬ জুলাই আবু সাইদ মারা যাওয়ার পর আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে তখন ‘স্বৈরাচারের পতন’ হবে- এ বিশ্বাস জোরালো হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh