আন্দোলনের সময় লিডার কে তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না

আমি আগে কখনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আন্দোলন হচ্ছিল, ফেসবুকে দেখছিলাম। কিন্তু এগুলো দেখে আমার টনক নড়েনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল, এগুলো তো বিগত সময়ে দেখে এসেছি। কিন্তু জুলাইয়ের ১৩-১৪ তারিখে এসে আমার মনে হলো আর চুপ থাকা যাচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপগুলোতে আমি লেখালেখি শুরু করলাম- ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কি মুভমেন্ট করবে না, আন্দোলনরত ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়াবে না?’

গ্রুপে আমার মতো অনেকেই এমন লিখতে থাকে। আমরা যারা লেখালেখি করছিলাম, তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। একেকজন একেক ব্যাচের। তবে এই লেখালেখির মাধ্যমেই আমরা পরিচিত হয়ে যাই। ১৫ জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর আক্রমণ নেমে আসে, সেদিনই মূলত আমরা যারা লেখালেখি করছিলাম তারা এক হই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন করে গ্রুপ খুলি এবং ১৬ জুলাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনের সমর্থনে অবস্থান কর্মসূচির কথা ঘোষণা করি। আমাদের সিনিয়ররা বলেছিলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কখনো এ ধরনের মুভমেন্টগুলোতে অংশগ্রহণ করে না।’ তাই আমাদের মনে হয়েছিল হয়তো আমরা যারা কথা বলছি, তারা ছাড়া আর কেউ আসবে না। তবে আমরা বন্ধুদের বলতে শুরু করি যে, ‘আমাদের সঙ্গে আগামীকাল সকাল ১১টায় এসে যোগ দিও।’ 

১৬ জুলাই সকালে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যখন দাঁড়াই, তখন মাত্র ১০ থেকে ১৫ জন ছিলাম। কিন্তু মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে সেখানে প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ মানুষ চলে আসে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন স্কুল ও স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই জমায়েতে ছিল। সেদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সাপোর্ট পাইনি। অবশ্য আমরা রাস্তায় নামার আগে তারা জানতও না যে আমরা আন্দোলনে নামছি। 

আমরা সেদিন সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অবস্থান করেছিলাম। মাঝখানে স্থানীয় কাউন্সিলর আসিফ ৫০ থেকে ৬০টি মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে আসে এবং আমাদের ভয় দেখাতে আকাশের দিকে অস্ত্র তাক করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। আমরা যে কয়জন জমায়েতের সামনে ছিলাম কাউন্সিলর আসিফ এসে তাদের প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছিলেন। আসিফের সঙ্গে তখন পুলিশও ছিল। তখন তার সঙ্গে আমাদের তর্ক-বিতর্ক হয়। সে তখন কিছু করতে পারেনি, কারণ ততক্ষণে মুভমেন্ট অনেক বড় আকার ধারণ করেছিল। সেদিন থেকেই মূলত প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।

১৭ জুলাই প্রক্টর আমাকে ফোন করে বললেন, ‘তোমাদের কী কী সহযোগিতা প্রয়োজন? অর্থনৈতিক, মানসিক, নাকি ম্যানপাওয়ার?’ এরপরের দিনগুলোতে এভাবেই বেশির ভাগ শিক্ষক আমাদের সমর্থন করতে থাকেন। একসময় আমরা বললাম, আপনারা আমাদের সঙ্গে আছেন তবে সামনে নেই, আপনারা এবার সামনে আসুন। জুলাইয়ের ৩১ তারিখ আমাদের আহবানে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়ান। সলিমুল্লাহ খান স্যার সেখানে বলেন, ‘এই যে এতজনকে খুন করা হয়েছে, এদের বিচার যে এখন করা হবে বলা হচ্ছে, বিচার কারা করবে? যারা বিচার করবে বলছে তারাই তো খুনি! তাহলে বিচারটা কারা করবে!’ তার এই বক্তব্য মানুষকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। 

এখানে আরেকজনের কথা বলতেই হয়, বিবিএর শিক্ষক জিসান স্যার। তিনি ১৫ জুলাইয়েই আমাদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে লিখেছিলেন ‘তোমরা শুরু করো। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।’ ১৬ তারিখ আমরা আরেকটি কাজ করতে পেরেছিলাম, ক্যাম্পাসের পাশে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং মোহাম্মদপুরের কিছু স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। ওদের একত্রিত করে বলি, ‘সবাই সম্মিলিতভাবে একটা জায়গায় অবস্থান নিলে ভালো হয়।’ তারপর থেকে আমরা এই ক্যাম্পাসগুলো এবং মোহাম্মদপুরের স্থানীয় জনগণ সম্মিলিতভাবে যখনই মোহাম্মদপুর তিন রাস্তা থেকে শুরু করে বেড়িবাঁধে অবস্থান নিতাম, পুরো রাস্তাটা ব্লকেড হয়ে যেত। ওই সময়গুলোতে আশপাশের বাড়ি থেকে একটু পর পর আমাদের খাবার থেকে শুরু করে যা কিছু প্রয়োজন তা দিয়ে আমাদের সাহায্য করা হতো। 

আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল কারফিউ ঘোষণা হতে পারে। ইন্টারনেটও বন্ধ করে দিতে পারে। তখনই আমি গ্রুপগুলোতে বিশেষ করে মেসেঞ্জারগ্রুপে বলে রেখেছিলাম, প্রত্যেকে যেন একে অপরের ফোন নাম্বারগুলো নিয়ে রাখে। ইন্টারনেট না থাকার দিনগুলোতে ফোন কলের মাধ্যমে আমরা যুক্ত হয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতাম। 

জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক আন্দোলন করছিল, কিন্তু আগস্টের শুরু থেকে সবার একটাই গন্তব্য হয়ে যায় ‘শহীদ মিনার’। 

জুলাই আন্দোলনে যারা আড়াল থেকে কাজ করেছেন, তাদের বিষয়ে অনেক কথাই হয়। তারা হয়তো একটা নির্দিষ্ট জায়গাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু যারা আন্দোলন করেছি, আমরা তাদের কথায় নামিনি। যেমন- আন্দোলনের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিডিওতে নাহিদ ভাই, আসিফ ভাইকে দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের চিনতাম না। যখন আবু সাঈদের ভিডিওটি দেখলাম তখন আমি তাকে চিনি, আমার রাস্তায় নামতে হবে আবু সাঈদের জন্য। এভাবেই আন্দোলনে আমরা যখন নামি তখন লিডার কে, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা ছিল না। 

একজন মেয়ে হিসেবে যদি বলি তবে আন্দোলনের দিনগুলোতে অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অনেক মিটিং হয়েছিল, যা শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ২টা-৩টা বেজে যেত। সে সময় আমার মা-বাবা দোকানে একটু কেনাকাটা করতে গেলে শুনতে হতো ‘আপনার মেয়ে তো রাত ২টা-৩টা পর্যন্ত বাইরে থাকে, এরপর সে বাসায় ফেরে।’ তবে এসব বিষয়ে মায়ের অসম্ভব সাপোর্ট ছিল। মা রাত জেগে অপেক্ষায় থাকতেন আমার ফেরার।

এখনকার কথা যদি বলি, তবে বলব, ‘যে মুদি দোকানদার দোকান বন্ধ করে, যে গার্মেন্টস শ্রমিক কারখানায় না গিয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা শুনতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল মানুষরা তা বাস্তবায়নে কাজ করবেন, এটাই আমার, আমাদের প্রত্যাশা।’

লেখক: শ্যামলী সুলতানা জেদনী, সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইউল্যাব ইউনিভার্সিটি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh