২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে নীতি সুদহার। সোমবার এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়।
গত ২২ অক্টোবর দেশের মুদ্রানীতির অন্যতম টুল নীতি সুদহার (ব্যাংক রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৪ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়, গত ২৫ আগস্ট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তীতে এটি ৯ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। ২০২২ সালের মে মাস নীতি সুদহার ছিল ৫ শতাংশ। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১০ বার বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার।
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভোগাচ্ছে দীর্ঘদিন। নানা পদক্ষেপের সঙ্গে সুদহার বাড়িয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এরই মধ্যে নীতি সুদহার (রেপো সুদ) আরেক দফা বাড়িয়ে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে ঘোষণার কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
উদ্যোক্তাদের মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না, এতে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানে।
সরকারি খাতে ঋণ কমবে, বাড়বে বেসরকারি খাতে
বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, জুন শেষে সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সাড়ে ১৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। ডিসেম্বর শেষে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির নতুন এই লক্ষ্যমাত্রার ফলে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধিও বাড়বে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী জুনে অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত সময়ের জন্য বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের শেষ ছয় মাসের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আড়াই শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে।
মুদ্রানীতি কেন গুরুত্বপূর্ণ
এই মুদ্রানীতির মাধ্যমে আগামী ছয় মাসের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রাখার দিকনির্দেশনা থাকবে। সেখানে আপনার স্বার্থও জড়িত। আপনার জীবনে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে নাকি কমবে, তা বুঝতে পারবেন। আবার কর্মসংস্থানের সুযোগ কতটা বাড়বে, এর দিকনির্দেশনাও পাবেন। উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ কতটা ব্যয়বহুল হবে, তা জানতে পারবেন।
বাংলাদেশের মুদ্রানীতিতে আগামী ছয় মাসের জন্য নেওয়া বেশ কিছু নীতির প্রতিফলন থাকে। পরের ছয় মাসে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য কত, তা মুদ্রানীতিতে ঘোষণা করা থাকে। এ জন্য ওই সময়ে নীতি সুদের হার কত থাকবে, এর দিকনির্দেশনা থাকে। আবার সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কত হবে, তা–ও ঠিক করে দেওয়া হয়।
সার্বিক পরিস্থিতি অনুসারে মুদ্রার সরবরাহ কেমন হবে, এর দিকনির্দেশনা থাকে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে খোলাবাজার কার্যক্রম, সংবিধিবদ্ধ জমার অনুপাত পরিবর্তনসহ সুদহার পরিবর্তনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ তথা মুদ্রার সরবরাহব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যের পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য দেওয়া হয় মুদ্রানীতিতে। রিজার্ভ মানি বা টাকা ছাপানো হবে কি না, এর প্রতিফলন থাকে।
মুদ্রানীতি যেভাবে সাধারণ মানুষের জীবন প্রভাবিত করে
সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো মূল্যস্ফীতি। আয়ের সঙ্গে সংগতি না রেখে খরচ বেড়ে গেলে অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষের কষ্ট বাড়ে। এ জন্য মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। মানুষের অপ্রয়োজনীয় ভোগকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আগের চেয়ে সুদের হার বাড়িয়ে ঋণের খরচ বাড়ানো হয়। এতে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হন। আমদানি খরচও বাড়ে। আবার বিলাস পণ্যে এলসি মার্জিন বাড়িয়েও পণ্য আমদানির রাশ টানা হয়। ফলে ভোগের চাহিদাও কমবে। বাজারে গিয়ে আপনি বিলাস পণ্যের দাম বেশি দেখলে কিনতে নিরুৎসাহিত হবেন।
তাই মুদ্রানীতিতে সুদের হার, মূল্যস্ফীতির হার এসব কমানো বা বাড়ানো হলো কি না, এর ওপর মানুষের জীবনধারণ কতটা স্বস্তির হবে, তা বোঝা যায়। মনে রাখতে হবে, শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ দিয়ে এ দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন। ১০ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি আছে।
সুদের হার বাড়ানোর অসুবিধাও আছে। সুদের হার বাড়ানো হলে প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়তে পারে। ঋণের সুদের হার বেড়ে গেলে উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ বা নতুন প্রতিষ্ঠান করতে উৎসাহিত হবেন না। এ কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে। সাধারণ মানুষের চাকরি বা কাজ কম পাবেন। এতে বেকারত্ব বাড়বে। কয়েক বছর ধরেই বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়।
মুদ্রানীতির মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, আগের ছয় মাসের তুলনায় পরের ছয় মাস বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানো হয়। এর মানে, সরকার বেসরকারি খাতে ঋণের লাগাম টেনে ধরতে চায়। এতে শিল্পকারখানার জন্য ঋণ কম যায়। বিনিয়োগ কমে যায়। এ কারণে তা জিডিপি প্রবৃদ্ধি তথা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ আটকে দেয়।
আবার ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। তাই বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ল নাকি কমল, এর ওপর সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টি অনেকাংশে জড়িত।
সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ফলেও বেসরকারি খাতে ঋণের ওপর প্রভাব পড়ে। বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নের জোগান দিতে ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকারকে বেশি ঋণ দেওয়া হয়। ফলে বেসরকারি খাত ঋণ কম পায়। অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আদায় কাঙ্ক্ষিত না হওয়ায় ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নেয়। এটি শেষ পর্যন্ত প্রথমে উদ্যোক্তা, পরে মানুষের ওপর চাপ বাড়ায়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : মুদ্রানীতি অর্থনীতি সুদহার মূল্যস্ফীতি
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh