পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্থাপত্য ও নির্মাণ খাতে বিশ্বব্যাপী ‘সবুজ ভবন’ বা পরিবেশবান্ধব নির্মাণের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশেও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সবুজ ভবন ধারণা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, শক্তি-সাশ্রয়ী নকশা ও পরিবেশবান্ধব উপকরণের মাধ্যমে নির্মিত এসব ভবন শুধু পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক নয়, দীর্ঘ মেয়াদে ব্যয় সাশ্রয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সবুজ ভবন কী?
সবুজ ভবন বলতে এমন স্থাপনা বোঝায়, যা নির্মাণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনে। সাধারণ ভবনের তুলনায় এসব ভবন কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে এবং সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবুজ ভবনের গুরুত্ব
বাংলাদেশের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে সবুজ ভবন নির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহরের ঘনবসতি, বায়ু ও পানিদূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি- এসব কারণে বাংলাদেশের জন্য সবুজ ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে একটি সবুজ ভবননীতি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। এই শহরের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এ ধরনের একটি নীতিমালা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সবুজ ভবনের ডিজাইন এবং টেকসই নির্মাণপদ্ধতি এই ঝুঁকির বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশে জ্বালানির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সবুজ ভবন শক্তির অপচয় রোধ করে ও সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে এই সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে। সবুজ ভবন ডিজাইন ও নির্মাণে ভবনগুলোতে প্রাকৃতিক আলো ও তাজা বাতাসপ্রবাহ নিশ্চিত করা হয়। এতে ভবনে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত হয়। এটি কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভবিষ্যতে মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরগুলোতে পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন। ভবনের নকশা এমনভাবে করতে হবে, যাতে দিনের বেলায় সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে, বৈদ্যুতিক বাতি ছাড়াই কাজ করা সম্ভব হয়। ভবনের ভেতরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া ব্লক ইটসহ পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারে জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশে সবুজ ভবনের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে সবুজ ভবনের সংখ্যা এখনো সীমিত, তবে ক্রমেই এর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। বিশেষ করে করপোরেট অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিজাত আবাসিক প্রকল্পগুলোতে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যের প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের LEED (Leadership in Energy and Environmental Design) সার্টিফিকেশনপ্রাপ্ত বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে সবুজ ভবনের স্বীকৃতি পায়।
তবে বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে সবুজ ভবনের ধারণাটি এখনো ততটা পরিচিত নয়। সাধারণ মানুষ এখনো জানে না, কীভাবে সবুজ ভবন তাদের জীবনের গুণগত মান বৃদ্ধি করতে পারে।
সবুজ স্থাপত্যের কিছু উদাহরণ
১. বসুন্ধরা সিটি (বাংলাদেশ) : ঢাকার অন্যতম বড় শপিং মল বসুন্ধরা সিটিতে প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহারের প্রয়োজন কমে যায়।
২. দ্য ক্রিস্টাল (লন্ডন, যুক্তরাজ্য) : লন্ডনে অবস্থিত এই ভবনটি শূন্য কার্বন নির্গমন সম্পন্ন প্রথম অফিস ভবনগুলোর একটি। এতে সৌরশক্তি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং অত্যাধুনিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
৩. বোসকো ভার্টিক্যাল (মিলান, ইতালি) : এই ভবনটি পুরোপুরি গাছপালায় আচ্ছাদিত, যা শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং বাতাসের গুণগত মান উন্নত করে।
বাংলাদেশে সবুজ স্থাপত্যের ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশে সবুজ স্থাপত্যের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে, রাজউকের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ঢাকার নতুন ভবনগুলোর ছাদে গাছ লাগানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পে সবুজ ভবনের নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
তবে সবুজ স্থাপত্যকে আরো জনপ্রিয় করতে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ভবন নির্মাণের সময় নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া দরকার।
সবুজ ভবনের চ্যালেঞ্জ
সবুজ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রাথমিক ব্যয়। বাংলাদেশে সবুজ ভবন নির্মাণের উপাদান। যেমন- সোলার প্যানেল, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সিস্টেম, উন্নত তাপ নিরোধক উপাদান এবং শক্তি সাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যবহার প্রচলিত ভবনের তুলনায় তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল। এই উপাদানগুলোর দাম বেশি হওয়ার কারণে ভবনের নির্মাণ খরচ বেড়ে যায়। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা সবুজ ভবন নির্মাণে নিরুৎসাহিত বোধ করেন।
বাংলাদেশে সবুজ ভবন নির্মাণে প্রশিক্ষিত প্রকৌশলী, স্থপতি এবং নির্মাণকর্মীর সংখ্যা খুবই কম। সবুজ ভবনের জন্য যে ধরনের বিশেষায়িত দক্ষতা ও জ্ঞান প্রয়োজন, তা এখনো বেশির ভাগ পেশাজীবী এবং কর্মীদের মধ্যে সীমিত। তারা নতুন প্রযুক্তি ও উপকরণের ব্যবহার সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন নন। এর ফলে অনেক নির্মাতা প্রচলিত পদ্ধতিতেই ভবন নির্মাণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
সবুজ ভবনের ডিজাইন ও নির্মাণ কেবল ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করবে না, বরং বাংলাদেশের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক অগ্রগতির ওপর গভীর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ যেভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে, তাতে সবুজ ভবন একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এই ভবনগুলো জ্বালানি খরচ কমানোর পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে। এই ব্যবস্থা দেশের জ্বালানির চাহিদা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সবুজ ভবনের সঠিক নকশা এবং টেকসই নির্মাণপদ্ধতি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ ও নিরাপদ পৃথিবী গড়ার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে। এই উদ্যোগগুলোকে সফল করতে হলে সঠিক নীতি এবং আর্থিক প্রণোদনা জরুরি, যা পুরো নির্মাণ খাতকে সবুজ ভবন নির্মাণের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবুজ প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
সার্বিক বিবেচনায়, সবুজ ভবন নকশা ও নির্মাণকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh