পিটার কাস্টার্স তেভাগা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বিপ্লবী এলাকাকে কাঁপিয়ে তুলেছিল যে অভ্যুত্থান, সেখানে মহিলাদের সাংগঠনিক সংগ্রাম ও নেতৃত্ব ক্ষমতার কার্যকরী প্রভাব থাকা সত্ত্বেও পুরুষের আধিপত্য অপ্রতিহত থেকে গেছে। অধিকাংশ বুর্জোয়া ও পিতৃতান্ত্রিক ঐতিহাসিকের কলম থেকে যেমন নির্লজ্জভাবে নারীর উপস্থিতিকে উপেক্ষা করা হয়েছে, তেমনি পুরুষের নেতৃত্বের আধিপত্য প্রাধান্য পেয়েছে।
সভ্যতার ইতিহাসজুড়ে নারী সামাজিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে নেদারল্যান্ডসের প্রধান খাদ্য আলুকে কেন্দ্র করে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল নিশ্চিতভাবে সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নারীরা। রাষ্ট্রশক্তির অত্যাচারের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন স্বামীদের ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের চিন্তাহীন খাদ্যশস্য রপ্তানির ফলে ডাচ শহরে-নগরে যখন দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া নেমে এসেছিল, তখন কর্মচ্যুত মহিলারাই আলু ও রুটি মজুদ করা গুদাম, জাহাজ ও রুটির কারখানা আক্রমণ করেছিলেন। পৃথিবীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে কোনো আন্দোলন ফলপ্রসূ হয়নি।
অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নারী যেমন ঘরে-বাইরে থেকে প্রত্যক্ষ সমর্থন ও অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনি পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি গণ-আন্দোলনে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ সব আন্দোলনকে বেগবান ও সফল হতে সাহায্য করেছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ছাত্রদের দু-তিনটি দল বের হয়ে যাওয়ার পরপরই সুফিয়া ইব্রাহিম, শাফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন্নাহার, সারা তৈফুর প্রমুখ ছাত্রী কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বের হন মিছিল নিয়ে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের পর নারীরা বিভিন্ন স্থানে সভা করে এর প্রতিবাদ জানান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নারীর অবদান আলোচনা করলে দেখা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। নারী তার সব সামর্থ্য প্রয়োগ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরিতে। তারা মুক্তিযুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ থেকে শুরু করে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, আহতদের সেবা করার জন্য নার্সিং ট্রেইনিং নিয়েছেন। অথচ আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর অবদানকে সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
যুদ্ধের সময় বাঙালি নারীরা সমরেও যে অনেক বড় সহায়ক শক্তি ছিল- এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় না। পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য এ দেশের নারী ও পুরুষ সম্মীলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। নারীরা কখনো সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নিয়েছেন, আবার কখনো যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। দুঃসাহসী নারীরা যে যেভাবে পেরেছেন, সেভাবে কাজ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনেও নারী বিশেষ করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
এরপর ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের বীরত্বপূর্ণ অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। আন্দোলনের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রীদের ওপর সরকার দলীয় ছাত্রদের প্রত্যক্ষ আক্রমণের ছবি পত্রিকায় ও সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে, আন্দোলন এক নতুন গতিতে ফুঁসে ওঠে। আবু সাঈদের হত্যা ও নারী নিপীড়ন একই সঙ্গে দাবানলের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নির্বিচারে গণহত্যা চলাকালেও নারী শিক্ষার্থীরা এক পা পিছু হটেনি। বরং ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বুলেটের মোকাবিলা করেছে দুর্বার গতিতে। যে সাহস অনুরণিত হয়েছে দেশের প্রতিটি গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে। শ্রমিক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, সন্তানের অভিভাবক নির্বিশেষে মানুষের ঢল নেমেছে রাজপথে।
তবে যেকোনো আন্দোলন সফল হওয়ার পর দেখা যায় নারীরা আন্দোলন চলাকালে যতটা সরব থাকে, আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে ততটাই পিছিয়ে পড়ে। এই পিছিয়ে পড়ার পেছনে শুধু যে নারীর রাজনীতিতে অনীহা প্রাধান্য পায় তা নয়, বরং কোনো এক নির্দিষ্ট সূত্র মেনে যেন নারীকে এগোতে দেওয়া হয় না। ২৪-এর আন্দোলনে সর্বস্তরে নারীদের ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে সংস্কার কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রে নারীদের প্রতিনিধিত্ব সেভাবে নিশ্চিত করা হয়নি। বরং নারীর ওপর পদে পদে নেমে এসেছে নানা নিষেধাজ্ঞা। ২৪-এর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা নারীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টার্গেট করে নানাভাবে নাজহাল করতে দেখা গেছে।
বলা যেতে পারে, ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা আছেন, সেখানে নারীদের আওয়াজ ক্ষীণ এবং সেটা বাড়ানো জরুরি। কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল নয়, রাষ্ট্রকেই প্রথম এই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। অতীতে যারা বৈষম্যের স্বীকার হয়েছিল তারাই সব ধরনের বৈষম্য নিরসনের জন্য আন্দোলন করেছে বলা বাহুল্য। সেখানে এখনো এ ধরনের বৈষম্য জিইয়ে রাখা নিশ্চয়ই কাম্য নয়।
এই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিটি পর্বে সাম্য, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ঘিরে নারীর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। অভ্যুত্থানের পরও নারীর সেই কল্যাণকর অস্তিত্ব ধরে রাখা আবশ্যক। রাষ্ট্রের রাজনীতিতে তার অন্তর্ভুক্তি দরকার। আর রাজনীতিতে নারীর সম্পৃক্ততা শুধু শিক্ষিত সমাজের নারীদের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশের অংশগ্রহণ নয়, বরং সব শ্রেণির নারীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। গ্রামের স্কুলের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া একটা মেয়ের রাজনৈতিক চিন্তা, গার্মেন্টসের একজন কর্মীর রাজনৈতিক চিন্তা, দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে জর্জরিত নারীর রাজনৈতিক চিন্তা, বা পাহাড়ে সুবিধাবঞ্চিত নারীর রাজনৈতিক চিন্তা উঠে আসা জরুরি। নতুন প্রজন্মের নারীর রাজনৈতিক ধারণা ও সচেতন চর্চা এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। নিজের পূর্ণ নাগরিক অধিকার আদায়ে নারীর সচেতন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় সোচ্চার হয়ে ওঠা ছাড়া বিকল্প নেই। অতীতে যেমন নারীদের ভূমিকা অস্বীকার করে তাদের সবক্ষেত্রে বঞ্চিত করার সংস্কৃতি ছিল, এই একবিংশ শতকে এসে সেই সুযোগ নিশ্চয়ই নারী কাউকে দেবে না! সর্বস্তরের মানুষের সংগ্রামে-ত্যাগে যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বোনা হয়েছে, সে বাংলাদেশের বিনির্মাণ অংশগ্রহণমূলক হবে- এটাই বাঞ্ছনীয়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh