মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানুষ যে সুদিনের প্রত্যাশা করেছিল, তা অচিরেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-অবিচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল মানুষ। প্রয়াত স্বনামধন্য সাংবাদিক নির্মল সেন এক উপসম্পাদকীয়তে তখন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।’ সে সময়ের পত্রিকাগুলোর রিপোর্ট দেখলে তৎকালীন সময়ের একটি চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে এ রকমই নৃশংস এক নাম- লেবু-কমলেশ-বিষ্ণু-মানিক হত্যাকাণ্ড। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে এটি তখন ভয়াবহতম হিসেবে পরিচিতি পায়। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের চার নেতাকে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১০ মার্চ গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় টুপরিয়া নামক স্থানে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। যে হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি।
হত্যাকাণ্ডের শিকার কমরেড ওয়ালিউর রহমান লেবু জন্মগ্রহণ করেছিলেন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার আড়পাড়া গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সময়ে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন এবং পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি কোনো ধরনের রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা না নিয়ে মেহনতি মানুষের মুক্তির আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষে নিজ এলাকায় উলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে চাকরি গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং পরবর্তী সময়ে জেনারেল মঞ্জুরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা। তার অসাধারণ সততা ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে তিনি গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষের কাছে ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি নিজে নির্বাচন না করে কোটালীপাড়ায় ন্যাপ নেতা কমলেশ বেদজ্ঞের নির্বাচন পরিচালনার জন্য চলে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে কমরেড কমলেশ বেদজ্ঞ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীর যোদ্ধা। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার টুঙ্গিপাড়া, বরিশালের উজিরপুর, মাদারীপুরের কালকিনি এবং রাজৈর নিয়ে এক বিরাট এলাকায় গড়ে ওঠা হেমায়েত বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড। মূলত এই বাহিনীর সামরিক পরিকল্পনা এবং সম্মুখসমরের সব যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিতেন।
কমলেশ বেদজ্ঞ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের কাছে ছিলেন এক ভয়ংকর আতঙ্কের নাম। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান এবং ত্যাগের কারণে এলাকায় এক জনপ্রিয় মানুষ হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন। তার বীরত্বগাথা ছিল রূপকথার মতো। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে তিনি কোটালীপাড়া থেকে ন্যাপ-সিপিবি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই সময়কার নির্বাচনে তিনি প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সন্তোষ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। কমলেশ বেদজ্ঞের নির্বাচন ছিল দক্ষিণ জনপদের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অনেক বিতর্কের মধ্য দিয়ে কমলেশ বেদজ্ঞ সামান্য ভোটে পরাজিত হন। এই নির্বাচনে তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন কমরেড ওয়ালিউর রহমান লেবু। নির্বাচনের পরে ৮ ও ৯ মার্চ লেবু, কমলেশ, বিষ্ণুপদ, মানিকসহ ন্যাপ সিপিবির নেতারা কোটালীপাড়ায় তাদের কর্মী-সমর্থকদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য জনসংযোগ সম্পন্ন করে ১০ মার্চ কোটালীপাড়া থেকে গোপালগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হন। তাদের সঙ্গে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের আরেক নেতা লুৎফর রহমান গঞ্জর। কোটালীপাড়া থেকে গোপালগঞ্জে আসার পথে টুপুরিয়া গ্রামে তারা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন এবং প্রকাশ্য দিনের বেলায় এই চার মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লুৎফর রহমান গঞ্জর আহত অবস্থায় দীর্ঘদিন দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে আছেন।
কিন্তু কেন এই হত্যাকাণ্ড তার সাধারণ বিশ্লেষণে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধকালে কোটালীপাড়া থেকে যেসব মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে গিয়েছিল তাদের অনেকেই তাদের মূল্যবান সম্পদ, স্বর্ণ, টাকা-পয়সা হেমায়েত বাহিনীর কাছে গচ্ছিত রেখে চলে যান। তাদের ভরসা ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের এই সম্পদ ফিরিয়ে দেবেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী ও রাজাকারদের ক্যাম্প দখল করেও যেসব মালামাল পাওয়া গিয়েছিল সেসব সম্পদের একটি তালিকা ছিল কমলেশ বেদজ্ঞের একটি ডায়েরিতে। সে ডায়েরিটাই মুক্তিযুদ্ধের পরে কাল হয়ে দাঁড়ায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সব হারানো মানুষগুলোর মধ্যে ডায়েরিতে লিখিত সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নে হেমায়েত বাহিনী প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই বিষয়টি নিয়ে সৎ-নির্লোভ কমলেশ বেদজ্ঞের সঙ্গে হেমায়েতের একটি বড় ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়।
ঘটনাটি ওয়ালিউর রহমান লেবু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবহিত করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন ডায়েরিটি তার কাছে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত করা হয় মুক্তিযুদ্ধে হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিনকে। জনরোষ তখন মারাত্মক আকার নেয়। হেমায়েত উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় জেলে। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তাকে বীরবিক্রম খেতাব দেওয়া হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে সিপিবি নেতা কমরেড মণি সিংহ বীরবিক্রম খেতাবের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এটা তার নামে আগেই বরাদ্দ ছিল।
এরপর ইতিহাসের আরেক কালপর্ব চলে এলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলো। ক্ষমতায় বসলেন খন্দকার মোশতাক সরকার। হেমায়েত বাহিনী মোশতাক বাহিনীর সঙ্গে ভিড়ে যায়। একইভাবে পতিত স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গেও তিনি ছিলেন। সব সরকারের কাছের লোক হিসেবে তিনি মামলার পেছনে লেগে থাকতেন। যে কারণে বারবার মামলার নথি হারিয়ে যেত আর বারবার মামলা স্থগিত হতো। ১৯৯৮ সালে ২৫ বছর পরে আবার মামলাটির শুনানি শুরু হয়। এলাকার মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তৎকালীন জজ আসামিদের জামিন বহাল রাখেন।
হেমায়েত উদ্দিন মারা গেছেন প্রায় আট বছর। গত ৫২ বছরে মামলাটি বারবার শুরু হয়েছে, কিন্তু আবার স্থগিত হয়েছে। ২০ জন আসামির বেশির ভাগের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। ওয়ালিউর রহমান লেবুর মা মারা গেছেন সন্তান হারানোর কষ্ট বুকে নিয়ে। কমলেশের বাবা-মা ও স্ত্রী মারা গেছেন একই কষ্ট বুকে নিয়ে। কমলেশ বেদজ্ঞের তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে পরিবারটির যে যুদ্ধ, সেটা ভয়াবহ ছিল। শুধু মুক্তিযুদ্ধ করার কারণে এসব দেশপ্রেমিককে হত্যা করা হয়েছে।
কোটালীপাড়ায় এখন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু কিংবদন্তিতুল্য মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞের নাম সে তালিকায় নেই। বিষ্ণু-মানিক কেউ নেই তালিকায়। শত শত অমুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে মূল মুক্তিযোদ্ধারা উধাও। কমলেশ বেদজ্ঞের সংগ্রামী কন্যা সুতপা বেদজ্ঞ আজও লড়ছেন পিতা হত্যার বিচার দেখতে। খুনিদের উত্তাপ একই রকম রয়েছে। শুধু সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো কমে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, চার মুক্তিযোদ্ধা হত্যার বিচার দেখার জন্য আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh