শ্বাসনালি পোড়াদের আশা জাগাচ্ছে যে থেরাপি

শ্বাসনালি পোড়া রোগীদের আশা জাগাচ্ছে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অত্যাধুনিক ‘হাইপারবারিক অক্সিজেন থেরাপি’ (এইচবিওটি)। থেরাপিটি ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও স্ট্রোকের রোগীদের চিকিৎসায়ও কাজে লাগছে। হাইপারবারিক থেরাপি চিকিৎসায় তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।

ফলে সরকারি-বেসরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালে সেবাটি দ্রুত চালু করা গেলে অসহায় রোগীদের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

তারা বলছেন, সাধারণত একজন মানুষ বাতাস থেকে শতকরা ২১ ভাগ অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকে। কোনো কারণে শ্বাসনালি পুড়ে গেলে ওই পরিমাণ অক্সিজেন শরীরে পৌঁছাতে পারে না। তখন পুড়ে যাওয়া শ্বাসনালি ফুলে সংকুচিত হয়ে আসে। রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে হাইপারবারিক অক্সিজেন থেরাপির মাধ্যমে শ্বাসনালি পোড়া রোগীর শরীরে সঠিক উপায়ে অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব, যা শ্বাসনালিকে সংকুচিত হওয়া থেকে রক্ষা করে।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিবছর বিভিন্নভাবে ৮ লাখ মানুষ অগ্নিদগ্ধের শিকার হন। বর্তমানে ১ কোটি ৩০ লাখের অধিক মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন এবং প্রতি লাখে ১১৪ জন ক্যানসারে আক্রান্ত। এই রোগীদের অনেকের চিকিৎসায় হাইপারবারিক অক্সিজেন থেরাপির প্রয়োজন হয়।

এ বিষয়ে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ‘বার্ন প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক সার্জারি’ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ রবিউল করিম খান পাপনের সঙ্গে কথা হয়। যিনি হাইপারবারিক অক্সিজেন থেরাপির ওপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তিনি বলেন, ‘আমরা বাতাস থেকে শতকরা ২১ ভাগ অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকি। ওই অক্সিজেন প্রথমে ফুসফুসে প্রবেশ করে, এরপর হৃৎপিণ্ডে যায়। সেখান থেকে রক্তের মধ্য দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে। 

তবে টিস্যু লেভেলে দেখা যায়, শতকরা ১ থেকে ২ ভাগ অক্সিজেন ব্যবহার হয়। কিন্তু দুর্ঘটনায় যখন শ্বাসনালি পুড়ে যায়, তখন তা দিয়ে শতকরা ২১ ভাগ অক্সিজেন শরীরে পৌঁছাতে পারে না। তখন শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া অনেক ক্যানসার ও স্ট্রোকের রোগীর শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছায় না, তাদের এই থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া যায়। যাদের শরীরে ফোলাভাব আছে তারাও এ থেরাপি ব্যবহার করতে পারেন। এটি রক্ত প্রবাহকে উন্নত করে। শরীরে অক্সিজেন পৌঁছে নতুন শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি হয়, শরীরকে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। যেসব ডায়াবেটিক রোগীর রক্তনালি সংকুচিত হয়ে যায় তাদেরও এ থেরাপি দেওয়া যায়।

হাইপারবারিক অক্সিজেন থেরাপি ইউনিটের ইনচার্জ কাজী শিহাব জানান, কারও পাকস্থলিতে বিষ গেলে ওয়াশ করা যায়। কিন্তু ফুসফুসে কার্বন-মনোক্সাইড গেলে তা বের করা কঠিন। থেরাপির মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এছাড়া রেডিওথেরাপি নেওয়ার পর অস্ট্রিও-রেডিওটিক আলসার (ক্ষত বা ঘা) হয়ে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে এ থেরাপিতে সুফল পওয়া যায়। ডায়াবেটিক ফুটের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েও ঘা না শুকানো, অটিস্টিক শিশুদের মানসিক বিকাশেও এ থেরাপি দেওয়া হয়। বর্তমানে দৈনিক গড়ে ৬ থেকে ১০ জন জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এ সেবা নিচ্ছেন।

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফোয়ারা তাসমীম বলেন, হাইপারবারিক অক্সিজেন থেরাপি নিতে চেম্বার মেশিনে ৬০ থেকে ৯০ মিনিট বসে বা শুয়ে থাকতে হয়। রোগী ভেতরে শুয়েই চিকিৎসক-নার্সদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। চেম্বারের ভেতরে ১০০ শতাংশ অক্সিজেন দিয়ে চাপ দেওয়া হয়। যার কারণে চাপ বেড়ে যায় এবং ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি অক্সিজেন রক্তরসে প্রবেশ করে। কোষে অক্সিজেন পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে কোষগুলো নতুন জীবন পেতে শুরু করে। ক্ষতিগ্রস্ত কোষ নিরাময় হয় এবং নতুন কোষ গঠন শুরু করে।

জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, প্রথম ২০১৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের জন্য দুটি হাইপারবারিক মেশিন কেনা হয়। ওই সময় চকবাজারের আগুনে দগ্ধদের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রেখেছিল এ মেশিন। এর আগে দেশে এ ধরনের দগ্ধ রোগীদের জীবন বাঁচানোর আশা করা যেত না। বর্তমানে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটেই ৬টি মেশিন রয়েছে। এগুলো রোগীদের মধ্যে আশা জাগাচ্ছে। ভারতসহ অন্যান্য দেশে এ চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। তাই দেশে থেরাপিটির সেবার পরিধি বাড়াতে পারলে মানুষ উপকৃত হবে। 

বিশেষজ্ঞরা জানান, বার্ধক্যের প্রভাব কমাতেও থেরাপিটি খুব কার্যকর বলে মনে করা হয়। থেরাপির মাধ্যমে ত্বকে নতুন কোষ তৈরি হয়, ত্বকে টোন পড়ে। ত্বক দীর্ঘ সময় ধরে তরুণ ও সুস্থ দেখায়। উন্নত বিশ্বে অনেক তারকা, সেলিব্রেটির কাছে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ক্রীড়াবিদ, মহাকাশচারী, ডুবুরি ও পাইলটদেরও এই থেরাপি দেওয়া হয়।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh