পাশে থাকলে সঙ্গী, না থাকলে ‘জঙ্গি’: বিএনপিকে ইঙ্গিত করে পরওয়ার

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দুই যুগের জোট সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা সামনে এনে বিএনপির নেতাদের নানা বক্তব্যের পর এবার পাল্টা বক্তব্য এসেছে একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা দলটির তরফে।

স্বাধীনতা দিবসে বুধবার জামায়াতের এক আয়োজনে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “ভোটাধিকারের আন্দোলনে তাদের সঙ্গে থাকলে, তখন বলে আমাদের সঙ্গী। না থাকলে বলে এরা জঙ্গি। সঙ্গে থাকলে আমাদের সব গুনাহ মাফ।”

জামায়াত নেতা অবশ্য সেই দলটির নাম নেননি। তিনি বলেন, “নাম বলতে চাই না, জনগণ তাদের চেনে।”

জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা আয়োজিত এই আলোচনায় কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল আরও বলেন, "৫৪ বছর পরে (স্বাধীনতার) এসে যারা বক্তৃতা শেষে বলেন ‘একাত্তরকে ভুলে যাবেন না’... তারা যখন দেশ শাসন করেছেন ১২ থেকে ১৩ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীকে’ প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছে, মন্ত্রী এমপি বানানো হয়েছে।"

‘জামায়াতের কার্ড’ নিয়ে খেললে শেখ হাসিনার মতো ‘নির্মমভাবে’ বিদায় নিতে হবে, হুঁশিয়ার করে দেন তিনি।

‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ ১৯৭১ সালে আসেনি দাবি করে পরওয়ার বলেন, "যারা মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছেন, এর চেতনার ফেরি করে বেড়াচ্ছেন তাদেরকে বলবো, আপনারা কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে দিল্লির কাছে দেশ বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। সেদিন বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি।

"যে কারণেই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ বলেছে, এটাই আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা।”

স্বাধীনতা দিবসে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আলোচনায় বক্তব্য রাখছেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার

‘শত্রু’ তুমি, ‘বন্ধু’ তুমি

১৯৯১ সালে সমঝোতা করে নির্বাচনে সুফল পাওয়ার ১০ বছর পর ১৯৯৯ সালে বিএনপি ও জামায়াত জোটবদ্ধ হয়, ২০২২ সালের শেষে এসে সেই জোট ভেঙে দেওয়ার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়।

এই ২৩ বছরের মধ্যে ২০০১ সালে জোটের ভোটে বিএনপি ভূমিধস বিজয় পেলেও ২০০৮ সালে দলটির নজিরবিহীন ব্যর্থতার পর নেতাদের মূল্যায়নে জামায়াতের সঙ্গে জোটের কারণে পরাজয়ের বিষয়টি উঠে আসে।

২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের পর জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এরপর এই দুই নেতার মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা সামনে আসে, তীব্র আক্রমণের মুখে পড়তে হয় বিএনপিকে।

২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি জোরাল হয়ে উঠে এবং আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে এই নির্বাচনকে ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করে। ভোটে বিএনপি ৩০টি ও জামায়াত দুটি আসনে জেতে, আওয়ামী লীগের আসন ছিল ২৩০টি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে।

নিজামী-মুজাহিদ ছাড়াও দলটির তিন শীর্ষ নেতা মীর কাসেম আলী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা ফাঁসিতে ঝুলেন, আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় নিয়ে বন্দি অবস্থায় মারা যান দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী; ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশে জামায়াতের ‘গুরু’ গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়ে বলা হয়, “গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্রিমিনাল দল হিসাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে।”

রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা জামায়াত নেতা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ মারা যান বিচার চলাকালে।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির রায় ঘোষণা করা আছে। রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় দণ্ড আটকে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রিভিউ শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আটকে গেছে।

এই বিচার চলাকালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জামায়াত নেতাদেরকে নির্দোষ বলে বক্তব্য রেখেছিলেন।

১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধ হয়, ২০০১ সালে মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দেন খালেদা জিয়া। ২০২২ সালের শেষে জোট ভেঙে যাওয়ার খবর আসে

তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দীর্ঘ দিনের দুই মিত্রের মধ্যে পরস্পরকে আক্রমণ করে কথা বলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিএনপির নেতারা কখনও দলের নাম নিয়ে, কখনও না নিয়ে একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা সামনে আনছেন।

স্বাধীনতা দিবসে দৈনিক সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “কিছু কিছু মানুষ ও কিছু কিছু দল বোঝানোর চেষ্টা করছে, ১৯৭১ সালে কোনো ঘটনাই ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের যে আন্দোলন, লাখ লাখ মানুষের যে আত্মত্যাগ, ৯ মাস ধরে বাড়িঘর ছেড়ে কোটি কোটি মানুষ যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই অবস্থা যেন আমরা ভুলে যাচ্ছি। যারা সরাসরি সহযোগিতা করেছে, সরাসরি হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছে তারা এখন গলা উঁচিয়ে কথা বলছে।”

মির্জা ফখরুল ছাড়াও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একাধিক দিন জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা তুলে এনে তাদেরকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ও বলেছেন।

‘ভাষা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে‘

পরওয়ারও কোনো দলের নাম না নিয়ে বলেন, “আওয়ামী লীগ ছাড়াও ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে আমরা যারা রাজপথে ছিলাম, সেই সংগ্রামী নেতাদের মধ্য থেকেও কিছু লোকের জামায়াত বিরোধিতার কথাগুলো, ভাষাগুলো আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ভাষার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।”

জামায়াতকে ইসলামী আন্দোলনের ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা’ দাবি করে দলের সেক্রেটারি বলেন, “জনপ্রিয়তা, গণজাগরণ প্রতিরোধ করতে সব সময় একটা শক্তি, একটা মহল, স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধকে জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষে দাঁড় করানোর একটা অপচেষ্টা করে থাকে। আওয়ামী লীগ এ কাজে সিদ্ধহস্ত। তারা বিদায় নিয়েছে।”

জামায়াত মুক্তিযুদ্ধকে সব সময় ধারণ করে দাবি করে তিনি বলেন, “আমাদের সংবিধানের (গঠনতন্ত্র) ভূমিকাতে সেটা আমরা ঘোষণা দিয়ে বলেছি। ঐতিহাসিক স্বীকৃতি প্রদান করেছি।”

বিএনপি ও জামায়াতের সাম্প্রতিক এই ‘দ্বন্দ্বের’ একটি কারণ হলো নির্বাচন। বিএনপি সরকার পতনের পর থেকেই দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে আর জামায়াত বলছে আগে সংস্কারের কথা।

স্বাধীনতা দিবসের আলোচনায় পরওয়ার বলেন, “জুলাই আন্দোলনে গণহত্যাকারীদের দৃশ্যমান বিচার ও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন নিতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করেই নির্বাচন দিতে হবে। অন্যথায় পূর্বের মতো বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।”

একই দিন জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মির্জা ফখরুল বলেছেন, আগের দিন জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ দেখে তারা হতাশ হয়েছেন। কারণ, সেই ভাষণে নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা ছিল না।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh