করোনার প্রণোদনা কি শুধু শহরবাসী পাবে?

ভয়াবহ করোনাভাইরাসের সংক্রমণে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। বিশেষ করে প্রায় দুই মাসের সাধারণ ছুটিতে উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে দাঁড়ায়। এতে গ্রাম-শহরের সব মানুষই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। 

তবে গ্রামের ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়ায় ঘূর্ণিঝড় আমফান ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। কিন্তু ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, তা শুধুই শহরকেন্দ্রিক বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জন্য। গ্রামের কৃষকের জন্য যৎসামান্য প্রণোদনা দিলেও তা বিতরণে আগ্রহ নেই ব্যাংকগুলোর। 

এছাড়া গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে একটি শিল্প প্যাকেজের মাত্র ১৫ শতাংশ গ্রামে বিতরণের নিয়ম করলেও ব্যাংকগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেটিও প্রত্যাহার করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কভিড-১৯ সংক্রমণে সারাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে। তবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে বেকায়দায় ফেলেছে একই সময়ের তিনটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা বেশি প্রয়োজন হলেও সেদিকে নজর নেই কারও।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৮ মার্চ থেকে। সংক্রমণ এড়াতে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। দুই মাসের সাধারণ ছুটিতে দেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে দাঁড়ায়। বড় উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাও ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তবে ক্ষুদ্রদের আঘাত অনেক ভয়াবহ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুটির ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো পরপর তিনটি মৌসুম পণ্য বিক্রি করতে না পারায় নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই তাদের।

শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে সচল করতে ব্যাংক ঋণভিত্তিক সাতটি প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। উদ্যোক্তারা অর্ধেক ও দু-একটি তহবিল থেকে অর্ধেকের কম সুদে ঋণ নিতে পারছেন। সব তহবিলের ঋণের সুদ ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। ওই সাতটি প্যাকেজের আকার ৮৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। তহবিলগুলো হলো- বড় শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, পরে আরো তিন হাজার কোটি বাড়িয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়; কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা; রফতানিমুখী শিল্পের জন্য বেতন প্যাকেজ পাঁচ হাজার কোটি টাকা; রফতানিকারকদের প্রাক-জাহাজীকরণে পাঁচ হাজার কোটি টাকা; রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) বৃদ্ধি ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা; কৃষকদের পাঁচ হাজার কোটি আর নিম্নআয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের জন্য তিন হাজার কোটি টাকা। 

এই ৮০ হাজার ৭৫০ কোটির মধ্যে মাত্র আট হাজার কোটি টাকা গ্রামের মানুষদের জন্য বরাদ্দ করা হয়; বাকি ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা শহরের উদ্যোক্তাদের জন্য। আবার গ্রামের মানুষদের জন্য যে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, তা বিতরণে বরাবরই অনাগ্রহ দেখাচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। 

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সবার আগে বিতরণ করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল। এই তহবিলের সুদহার মাত্র এককালীন দুই শতাংশ। রফতানিমুখী শ্রমিকদের জন্য গঠিত তহবিলের পুরোটাই বিতরণ হয়েছে। বৃহৎ শিল্প মালিকদের জন্য গঠিত ৩৩ হাজার কোটি টাকা তহবিলের ৭২ শতাংশ বা ২০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকাও বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। তবে সিএমএসএমই খাতের তহবিলের ২০ হাজার কোটির মাত্র ১৫ শতাংশ বা ৩ হাজার ৭৫ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে। 

অপরদিকে কৃষকদের প্যাকেজের মাত্র ১০ শতাংশ এবং নিম্নআয়ের মানুষদের প্যাকেজের মাত্র ৯ শতাংশ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। কৃষক ঋণ পেয়েছেন মাত্র ৪৯৭ কোটি টাকা ও নিম্নআয়ের অন্য পেশাজীবীরা পেয়েছেন ২৭৬ কোটি টাকা। 

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘বৃহৎ শিল্প প্যাকেজের ঋণ বিতরণ ভালোভাবে হচ্ছে। এসব প্যাকেজের ঋণ আরো বাড়ানো প্রয়োজন। তবে অন্য প্যাকেজগুলোতে সময় লাগছে। কারণ সারাদেশ থেকে আবেদনপত্র নিয়ে তা যাচাই-বাছাই করতে সময় প্রয়োজন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিতরণ করা সম্ভব হবে।’ 

সিএমএসএমই প্যাকেজের ঋণ বিতরণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনাগ্রহ জানতে গত ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈঠকে শীর্ষ ২৬ ব্যাংক ও ২০ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিরা অংশ নেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গণহারে উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ আগে বন্ধ করা হয়। বেশি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে গ্রাহক প্রতি ঋণসীমা উৎপাদন, বাণিজ্য ও সেবাখাতে যথাক্রমে ৫০, ৩০ ও ২০ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়। এখন মাত্র দুটি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ পাবেন ৮০ শতাংশ করে। আর গ্রামের উদ্যোক্তাদের জন্য মাত্র ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দাবি করে, গ্রামের চেয়ে শহরে করোনাভাইরাস ক্ষতি বেশি করেছে। গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার প্রয়োজন পড়ার মতো ক্ষতি হয়নি। তহবিলের ঋণ বিতরণের গতি আনতে এটি প্রত্যাহার করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা এমডিদের সাথে একমত পোষণ করেন। তড়িঘড়ি করে পরের দিনই গ্রামে ১৫ শতাংশ ঋণ দেয়ার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকই গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কেড়ে নেয়। 

বৈঠকের লিখিত কার্যপত্র প্রস্তুতের আগেই গভর্নরের মৌখিক নির্দেশে গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে সার্কুলার জারি করা হয়। ওই সার্কুলারে বলা হয়, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ২০ হাজার কোটি টাকা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিতরণের লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে গ্রাম ও শহরের জন্য নির্দিষ্টকৃত লক্ষ্যমাত্রা এতদ্বারা রহিত করা হলো।

ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের উদ্যোক্তা, অর্থনীতি বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেই বেশি। করোনাভাইরাসের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন গ্রামীণ উদ্যোক্তারা। এমনিতেই গ্রামে ঋণ দিতে চায় না ব্যাংকগুলো। সেখানে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়ার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি হঠকারী। এতে ওই উদ্যোক্তারা আর ঋণ পাবেন না। করোনাভাইরাসের কারণে শহর ও বিদেশ ছেড়ে অনেকে গ্রামে চলে এসেছেন। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে এ প্যাকেজের অন্তত ৫০ শতাংশ গ্রামে বিতরণ করা উচিত ছিল; কিন্তু মাত্র ১৫ শতাংশ দিয়েও তা ব্যাংকগুলোর চাপে প্রত্যাহার করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি সরকারের পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত।’

তিনি আরো বলেন, ‘শহরের তুলনায় গ্রামের ক্ষতি ব্যাপক। আর এ ক্ষতি থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে গ্রামের উন্নয়ন সবার আগে করতে হবে। কারণ বিদেশে বাজারের ওপর নির্ভর না করে স্থানীয় বাজার চাঙ্গা করতে হবে। এ জন্য শুধু শহরকেন্দ্রিক চিন্তা না করে সারাদেশের উন্নয়নের চিন্তা করতে হবে।’

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘১৫ শতাংশ দেয়ার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করার অর্থ এ নয়, সেখানে ঋণ বিতরণ বন্ধ করা হয়েছে। চাহিদা থাকলে ঋণ বিতরণ করবে ব্যাংকগুলো। যেখানে চাহিদা বেশি, সেখানে ঋণ বিতরণ করবে ব্যাংকগুলো। তবে চাহিদা না থাকলে ঋণ বিতরণ করবে কীভাবে? যদি চাহিদাই না থাকে, তা হলে বাধ্য করে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধি করা যাবে না।’

এ দিকে কৃষি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ওয়াচের (ডিএমওয়াচ) এক জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আমফানে কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। একইসাথে তিনটি দুর্যোগে ফসল নষ্ট হওয়া, বাজারে দাম কম পাওয়া ও কৃষি উৎপাদন সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে আর্থিক সংকটে পড়েছেন কৃষক। তাদের সহায়তায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার; কিন্তু নানা জটিলতায় কৃষকরা ব্যাংক থেকে প্রণোদনা নিতে পারছেন না। মাত্র ১১ শতাংশ কৃষক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছেন। বাকিরা স্থানীয় এনজিও, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কৃষিকাজ সচল রাখছেন।

সারাদেশের ১০টি জেলার ১২০ কৃষকের ওপর জরিপ চালিয়ে গবেষণাটি করা হয়। এতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। মধ্য মে থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত ওই জরিপ চালানো হয়।

ডিএমওয়াচের উপদেষ্টা ড. ফয়সাল কবির বলেন, ‘জরিপ ও সরকারি সংস্থার তথ্যমতে, কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর্থিক সংকটে পড়েও অর্থ সহায়তা পাচ্ছেন না। কৃষকদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও ব্যাংকের নানা কাগুজে জটিলতায় তারা ঋণ পাচ্ছেন না। সরকারের উচিত কৃষকদের কৃষি উৎপাদনে ফিরে যেতে সহায়তা করা।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //