মন্দা বিনিয়োগে বাড়ছে আমানত

করোনা মহামারিতে মানুষের আয় কমেছে। কিন্তু ব্যাংক আমানতে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। এ সময়ে বিপুল পরিমাণ আমানত জমা পড়ছে ব্যাংকগুলোতে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রথমবার আমানতের পরিমাণ ১৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর আগে কখনো এত বিপুল আমানত দেখা যায়নি।

গত এক বছরে ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা নতুন রেকর্ড। এ সময়ে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। আগের মাস মার্চে বার্ষিক এই প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। এমন এক সময়ে আমানতে এত উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, যখন আমানতের বিপরীতে মুনাফার হারে ব্যাপক পতন হচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকে আমানত রাখলে ৩-৪ শতাংশের মতো সুদ মিলছে। 

ব্যাংকে আমানতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হওয়ার পেছনে চারটি কারণ চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এগুলো হলো করোনায় অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে সঞ্চয়ে মনোযোগী হওয়া, নতুন বিনিয়োগ থমকে যাওয়া, রেমিট্যান্সে ভালো প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের উত্তম বিকল্প সঞ্চয়পত্র কেনায় কড়াকড়ি আরোপ। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা থেকে মানুষ সঞ্চয় করে। আর করোনা মানুষকে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখোমুখি করেছে। এতে মানুষ অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে সঞ্চয়ে মনোযোগী হয়েছে। এ ছাড়া করোনার মধ্যেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। ওই রেমিট্যান্সের একটা অংশ ব্যাংকে রাখছে প্রবাসীদের পরিবারগুলো। অন্যদিকে করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এতে লোকসানের আশঙ্কায় অনেকেই নতুন বিনিয়োগ ও ব্যবসায় যেতে সাহস করছে না। ফলে তাদের মূলধনের টাকাও আমানত হিসেবে ব্যাংকে ঢুকছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনায় টিআইএন বাধ্যতামূলকসহ বিভিন্ন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে টিআইএনের ঝামেলা এড়াতে ব্যাংকেই টাকা রাখতে পছন্দ করছেন বিনিয়োগকারীরা।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, করোনার মধ্যে প্রবাসী আয় অনেক বেশি এসেছে। সেই তুলনায় উত্তোলন হয়েছে কম। এসব টাকার বড় অংশ ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা হয়েছে। আগে যারা সঞ্চয় করেননি, তারাও করোনাকালে সঞ্চয় করতে শুরু করেছেন। চাকরিজীবীরাও সব ধরনের বিনিয়োগ ও খরচের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছেন। আসলে করোনা সবাইকে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়ার কারণেই সঞ্চয়ের প্রবণতা ও পরিমাণ বেড়েছে।    

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত রয়েছে সোনালীর। গত ডিসেম্বর শেষে এই ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। সোনালীর পেছনে রয়েছে অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক। 

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘করোনার মধ্যে আমানতে নতুন চিত্র দেখতে পেয়েছি। এক বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। মানুষ খরচ কমিয়ে সঞ্চয় বাড়িয়ে দিয়েছে। আর নতুন প্রকল্প না হওয়ায় তেমন ঋণও যাচ্ছে না।’

বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি আমানত রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের। জানুয়ারি শেষে ব্যাংকটিতে আমানত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের জুনে ছিল ১ লাখ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকটিতে আমানত ছিল ৯৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।

পূবালী ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ ৪৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এরপরই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৪৩ হাজার ১৫৮ কোটি ও ন্যাশনাল ব্যাংকে ৪২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার আমানত রয়েছে।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্বে) শফিউল আলম খান চৌধুরী বলেন, ‘করোনায় অনেক ব্যবসায়ী চুপ হয়ে পড়েছিলেন। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণিও ঝুঁকি নিয়ে কোথাও বিনিয়োগ করেননি, টাকা খরচ না করে সঞ্চয় করেছেন। ভবিষ্যতে কী পরিস্থিতি আসে, সেই বিবেচনা করে সবাই সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এ কারণেই আমরা ভালো আমানত পেয়েছি, যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।’

বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়। এ বিষয়ে একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও দুর্বল ভিত্তির ব্যাংকগুলোর কথা চিন্তা করে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বেঁধে দেয়া থেকে বিরত থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বেঁধে দেয়া হলে আমানতকারীদের যেমন ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল, তেমনি দুর্বল ভিত্তির ব্যাংকগুলোর নতুন আমানত পাওয়া এবং বিদ্যমান আমানত ধরে রাখা কঠিন হতো। 

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়া না হলেও ঋণের সুদ ৯ শতাংশ কার্যকরে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির পক্ষ থেকে প্রায় দুই মাস আগে (১ ফেব্রুয়ারি) ব্যক্তি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ কার্যকর করার ঘোষণা দেয়া হয়। ওই ঘোষণার পর থেকেই আমানতের সুদহার কমাতে শুরু করে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ ঋণের সুদহার ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হলেও আমানতের সুদ ৬ শতাংশ কার্যকর শুরু হয় অনেক আগেই। 

তবে যে উদ্দেশ্যে ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়, সেটি কার্যকরের আগেই দেশে মহামারি করোনার আঘাত আসে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেসরকারি বিনিয়োগ থামকে যায়। ফলে ঋণের সুদহারের সঙ্গে আমানতের সুদহারের পতনও অব্যাহত রয়েছে। এরপরও ব্যাংকে আমানত ঠিকই বাড়ছে। 

বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনার কারণে এখন ব্যবসা হচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগও থমকে আছে। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখার বিকল্প নেই। আবার মানুষকে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কথাও ভাবতে হচ্ছে। কারণ করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সামনে কী হবে সেটা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। তাই খরচ কমিয়ে যতটা সম্ভব সঞ্চয় করছে মানুষ। এ ছাড়া করোনার কারণে মানুষ অভ্যাসগত অনেক কিছু থেকে বিরত থাকছে। যেমন হোটেলে খেতে যাচ্ছে না। ঘুরতে বের হচ্ছে না। দেশের বাইরে যাচ্ছে না। ফলে তাদের খরচও কমেছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার কারণে উদ্যোক্তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো নেই। অনেকেই পুঁজি স্বল্পতায় ভুগছে। তা সত্ত্বেও ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে, এটাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক অবস্থা বলা যাবে না। কী কারণে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্যের এমন স্ফীতি তা খতিয়ে দেখা দরকার।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংক খাতের জন্য ক্ষতিকর। বেসরকারি খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ না হওয়ার জন্য এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে কম সুদে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ দেয়ার মধ্য দিয়ে তারল্য কমিয়ে আনা যায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //