পাচারের অর্থ ফেরত আসে না কেন?

সরকারি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক দুর্নীতি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়। বাড়তি খরচ না করলে নাগরিকরা যেমন কোনো সেবা পান না, তেমনি কোনো প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে পারে না সরকার নিজেও। আর্থিক লেনদেনের ভাগবাটোয়ারা সরকার বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান পায় না। যারা এগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন তারাই অর্থ নয় ছয়ের সুযোগ পাাচ্ছেন যুগের পর যুগ। বিনামূল্যের সেবা নগদ অর্থ দিয়ে গ্রহণ কিংবা ৪ হাজার টাকার বালিশ ১৭ হাজার টাকায় কেনা কিংবা অবৈধ কমিশন বা ঘুষ লেনদেনের বাড়তি অর্থের গন্তব্য কোথায়? 

বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, হোটেল-রিসোর্ট, ব্যাংক-ব্যালান্স, জায়গা-জমিতে দৃশ্যমান কোটিপতি কারবারিদের; কিন্তু শত কোটি বা হাজার কোটির মালিকদের তথ্য চোখে পড়ে না খুব একটা। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা এসব প্রভাবশালীদের বসবাস কানাডার বেগম পাড়ায়, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি কোনো দেশে। কাগজে-কলমে এদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো তথ্য নেই; কিন্তু বাড়ি-গাড়ি আছে, আছে বিদেশে ব্যবসা এমনটি নিজেরাও প্রচার করে থাকে। 

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর পাচার হয় ৮০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিনিয়ত পাচারের পরিমাণ বাড়ছে; কিন্তু ফেরত আসার কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি হওয়া রিজার্ভ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। পাচারকৃত এবং চুরি হওয়া অর্থ ফেরত কবে আসবে এ নিয়ে কোনো পক্ষের কাছে নেই সঠিক উত্তর। 

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অর্থ পাচার হচ্ছে। এই তথ্য জানা যায় বিভিন্ন দেশের গবেষণা প্রতিবেদনে; কিন্তু অর্থ পাচার হচ্ছে কি-না, কি পরিমাণ হচ্ছে, কারা করছে, কীভাবে করছে তার কোনো তথ্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে নেই। কোনো তথ্য না থাকায় সেটি নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাচ্ছে না।

অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)। এই প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গত ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। প্রতি ডলার ৯০ টাকা ধরে স্থানীয় মুদ্রায় দাঁড়ায়, চার লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৮৭ কোটি ১০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে। ২০০৯ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫২১ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৬৮৪ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৮৭৩ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার ও ২০১৩ সালে ৯৩৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাচার করা হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

সাধারণত দুটি প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে আছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং)। দুই প্রক্রিয়াতেই বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়। ২০০৯ সালের পরে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অবৈধভাবে উপার্জিত, আন্ডার-ইনভয়েসিং এবং ওভার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়। বিশ্বেও বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের ঘটনা আছে। আমরা সবাই জানি, কানাডায় অর্থ পাচারের মাধ্যমে বেগম পাড়া গড়ে তোলা হয়েছে। এর বাইরে সুইস ব্যাংকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কিছু মুনাফার অর্থ আছে। এর বাইরে পাচারের টাকাও রয়েছে।

বাংলাদেশিদের অবৈধ অর্থের আরেক গন্তব্য সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো। ব্যাংকের আমানতকারীদের বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার আইন থাকায় ব্যাংকে কার নামে কী পরিমাণ অর্থ জমা আছে, তা জানতে পারে না সরকারের অন্য কেউ। এ জন্য সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো টাকা পাচারকারীদের কাছে নিজস্ব সিন্ধুকের মত।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পাহাড় জমেছে। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকে জমা অর্থের পরিমাণ ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্রাংক, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ৯৪ টাকা হিসাবে)। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। তবে ব্যক্তির নাম কোনোভাবে প্রকাশ করা হয় না। 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মুনসুর বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মুদ্রা পাচার হয়। এ ছাড়া নিরাপত্তাহীনতা, বিনিয়োগ ঝুঁকির কারণেও অর্থ পাচার হয়। উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত রাষ্ট্রে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এগুলো সমাধান করলে টাকা পাচার বন্ধ হবে।

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বড় ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। অন্যান্য অর্থপাচারের ঘটনা ধরা পড়েনি। এটি ধরা পড়েছে, তবে চোরদের শনাক্ত করে আজ পর্যন্ত অর্থ আদায় ও সাজা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে খোয়া যায় ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার। পরে শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইন স্বেচ্ছায় ফেরত দেয় সাড়ে ৩ কোটি ডলার। এর বাইরে আর কোনো অর্থ উদ্ধার করতে পারেনি বাংলাদেশ। অর্থ ফেরত ও দোষীদের চিহ্নিত করতে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়; কিন্তু সেই মামলা চলবে কি-না তিন বছরেও সেই রায় পাওয়া যায়নি। আবার ফিলিপাইনে চলমান ১২টি মামলারও রায় হয়নি। রিজার্ভ চুরির অর্ধযুগে বাংলাদেশের অর্জন যেন শুধু এসব মামলা। উদ্ধার না হওয়া ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার (প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা) আদৌ পাওয়া যাবে, সে অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে।

এসব ঘটনার বাইরে পিকে হালদার, হলমার্ক গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, নর্মস গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। অনেকেই ধরা পড়লেও বেশির ভাগ সপরিবারের বিদেশে পালিয়ে গেছেন। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক থেকে একবার অর্থ বের হয়ে গেলে তা আদায় করা অনেক কঠিন। অন্য দেশে পাচার হয়ে গেলে তা আরও কঠিন। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা চালিয়ে নিতে হবে। ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন দেশটির রিজাল ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি করে সে চেষ্টা করতে হবে। 

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা জানা যায় আরও কিছু বৈশ্বিক প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে পানামা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স, মালয়েশিয়া সরকারের সেকেন্ড হোম প্রজেক্ট রিপোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিজস্ব সেল রয়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) রয়েছে। সংস্থা দুটি পাচার সংক্রান্ত আজ পর্যন্ত উল্লেখ্য কোনো বড় অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশের বিভিন্ন নাগরিক ও কোম্পানির পাচারের মাধ্যমে বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংক বিশেষত সুইস ব্যাংক গোপনে জমা রাখা বিপুল অর্থ উদ্ধার এবং পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা, অর্থের পরিমাণ এবং ওই অর্থ উদ্ধারে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, উচ্চ আদালত জানতে চেয়ে গত বছর দুটি রুল জারি করেছে। রুলের জবাবে পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম এসেছে, বাংলাদেশের এমন ৪৩ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের তালিকা হাইকোর্টে দাখিল করেছে দুদক।

বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফরত আনার ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয় না বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই ক্ষেত্রে দেশের এবং আন্তর্জাতিক আইনের কিছু জটিলতা আছে। এটা অবশ্য দুই দেশ আইনগত চুক্তি স্বাক্ষর করে এগিয়ে নিতে পারে; কিন্তু সেই উদ্যোগ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তেমন দেখা যাচ্ছে না। 

তিনি আরও বলেন, এগুলো যারা করবেন, তারা অনেক প্রভাবশালী। তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। পাচার করা যে অর্থ ফেরত আনা হবে, আইনে তার দ্বিগুণ জরিমানার বিধান আছে। এ ছাড়া চার থেকে ১২ বছরের শাস্তির বিধানও আছে। এই জরিমানা ও শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে পাচার বন্ধ করা যাবে না। কারণ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে, অন্যরাও পাচার করা অর্থের কিছু ফেরত দিয়ে বৈধতা নেবে এবং একই কাজ অব্যাহত রাখবে বলে মনে করেন তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //