ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ল

কয়েক বছরের আর্থিক সংকটে সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা। প্রতিনিয়ত তাদের আয়ের তুলনায় ব্যয়ের বোঝা ভারী হচ্ছে। ঋণের চাপে পিষ্ট হয়ে কোনো রকমে জীবন চালাচ্ছেন এই শ্রেণির মানুষেরা।

এখন সেই ঋণের ব্যয়ও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ভোক্তা ঋণের সুদ ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করেছে। ফলে আগের তুলনায় ১০০ টাকায় ৩ টাকা বেশি সুদ গুনতে হবে সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের। এই সিদ্ধান্তের ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে। 

মূলধনের ব্যয় কমাতে নয়-ছয় সুদহার কার্যকর করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১ সালের আগস্টে আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদ কোনোভাবেই তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির কম হতে পারবে না। আর ২০২০ সালের এপ্রিলে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৫ জানুয়ারি রবিবার ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এই নয়-ছয় সুদহার সীমা উঠিয়ে দিয়েছে। 

এত দিন ক্রেডিট কার্ড ছাড়া ভোক্তাঋণসহ সব ধরনের ঋণের সুদ ৯ শতাংশে বেঁধে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন করে ভোক্তাঋণে সুদ বাড়ানো হলেও অন্য ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে চিকিৎসা ঋণ থেকে শুরু করে গাড়ি কেনা, শিক্ষাঋণসহ সব ধরনের ভোক্তাঋণে খরচ বাড়বে। সাধারণত এ ধরনের ঋণকে অনুৎপাদনশীল ঋণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। ফলে গত কয়েক বছরে মানুষের জীবনমানের যে উন্নতি হয়েছিল, তার ক্ষয় হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের ব্যয়ের চাপ শুরু হয় ২০১৯ সালে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের প্রায় শুরুর দিক থেকে। 

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ এড়াতে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। অনেকেই কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পর্যায়ের অনেক মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েন। এরপর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ডলারের বিনিময় মূল্য এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অধিকাংশ পণ্যের দাম ৫০ শতাংশ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। 

সরকারও গ্যাস, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এসব সংকটের ভয়াবহ শিকার নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা। এখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সিদ্ধান্তের ফলে ওই শ্রেণির মানুষদের ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়ল। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। একসময় মধ্যবিত্তরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মী ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তারা নিজেরাও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের মানুষের একটি অংশকে ঋণ করে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। 

এখন ভোক্তাঋণের সুদ বাড়ানোর ফলে তারা হয়তো চাপে পড়বেন। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে। দেরিতে হলেও আংশিকভাবে আমরা সেই পথে গেছি। তবে বিদ্যমান নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী, নতুন ভোক্তাঋণের পাশাপাশি এরই মধ্যে যারা এ ঋণ নিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রেও নতুন সুদহার কার্যকর হবে। ভোক্তা ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে দিলেও আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগেও আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংক সেই নির্দেশনা পরিপালন করেনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হিসাব অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৮২ শতাংশের বেশি।

তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সীমা অনুযায়ী আমানতের সুদহার-এ গড় মূল্যস্ফীতি কম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ দিচ্ছিল সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ শতাংশের মতো। ফলে আমানতের সুদ নিয়ে একধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে ব্যাংকগুলো। কারণ ৮ শতাংশের বেশি সুদে আমানত নিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া ব্যাংকগুলোর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। 

সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের অনেকে বাড়তি খরচ সামাল দিতে বাধ্য হয়ে ব্যাংকঋণে ঝুঁকেছেন। এ কারণে ভোক্তা ঋণও বাড়ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাস জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে ভোক্তাঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকগুলোতে ভোক্তাঋণের স্থিতি ছিল ৯৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকায়।

এদিকে শিল্পঋণের সুদ কম রেখে ভোক্তাঋণের সুদহার বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য চাহিদা কমানো। এ জন্য ভোক্তা ঋণের সুদ বাড়ানো হয়েছে। অর্থনীতির পরিস্থিতি ভালো হলে শিল্পঋণের সুদের সীমাও তুলে দেওয়া হবে। আমরা ভালো পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছি। ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কে বিনিয়োগ করবে। সুদ বাড়ানো হলে রপ্তানি কমে যাবে, অনেকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //