রাজস্ব ঘাটতিতে ঋণ বাড়ছে সরকারের

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা ও বিভিন্ন কৌশলে রাজস্ব ফাঁকির কারণে সরকারের রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। ফলে লক্ষ্যমাত্রায় প্রকৃত আয়ে ঘাটতি বাড়ছে।

চলতি অর্থবছরের আট মাসে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা কিন্তু সরকারের ব্যয় থেমে থাকছে না। ব্যয় মেটাতে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। ঋণের জন্য সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ছে ব্যাংকিং খাতের উপর। ঘাটতি মেটাতে ইতোমধ্যে সরকার প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা না থাকলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো  নিয়ে চাপে থাকে সরকার। অনেক সময় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গুলোকে কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। 

সরকার প্রতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যয়ের বিপরীতে আয়ের যে প্রাক্কলন করে তার সিংহভাগই আসে রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে। আবার এই রাজস্ব আয়ের সিংহভাগ সংগ্রহ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। চলতি ২০২৩-২৩ অর্থবছরের  ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর আদায় করবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। 

বাংলাদেশে সবসময়ই জিডিপির তুলনায় সবচেয়ে কম রাজস্ব আয় করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাতে শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে ওপরে আছে বাংলাদেশ। বর্তমানে কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশের কম। জিডিপির অনুপাতে করের পরিমাণ ন্যূনতম ১৫ শতাংশে উন্নীত করা উচিত।

জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তা কোনো বছরই পূরণ হয় না। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও রাজস্ব ঘাটতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না সরকার। প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ছে সেই ধারাবাহিকতায় রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়ানো হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এই সময় আয় হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। এই হিসেবে ঘাটতি হয়েছে ২২ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। তবে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ঘাটতি হলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব ১২ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়েছে। 

অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলেছেন, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়ার পাশাপাশি কিছু পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যরোধে রাজস্বে ছাড় দেওয়ায় রাজস্ব ঘাটতি বেড়েছে।

রাজস্ব আয়ের বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার প্রধান কারণ ডলার সংকট, আমদানিকৃত কিছু পণ্যে কর অব্যাহতি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া। এনবিআরের রাজস্ব আয়ে ঘাটতির প্রবণতা চলমান থাকতে পারে। কারণ এখনো ডলার সংকট রয়েছে। এ রকম চলতে থাকলে আইএমএফের শর্ত পূরণে রাজস্ব বোর্ড ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। 

এনবিআরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে রাজস্ব ঘাটতি বেশি হয়েছে। এর পরিমাণ ১৩ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। এরপরই রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে মূসক ঘাটতি ৫ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। সবচেয়ে কম ঘাটতি হয়েছে আয়কর ও ভ্রমণ করে ৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারের নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিতে শুল্ক আয় কমেছে। এছাড়া আমদানিকে ব্যবহার করে যেসব পণ্য উৎপাদন হয় সেখান থেকেও রাজস্ব আয়ে প্রভাব পড়ছে। আইএমএফ ট্যাক্স রাজস্বের একটা ফ্লোর ঠিক করে দিয়েছে জুনের জন্য। তার চেয়ে কম আয় হলে আইএমএফ পরবর্তী সময়ে আলোচনা করবে কীভাবে সেটা বাড়ানো যায় তা নিয়ে।

কর আহরণ বাড়াতে যে ধরনের সংস্কার দরকার তা এখনো হয়নি বলে মনে করেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, রাজস্ব আয়ে রাজস্ব বোর্ড যে লক্ষ্যমাত্রা দেয় সেটা কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করে দেওয়া হয় না, এটা অনুমাননির্ভর।

যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়, সে অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ করতে হলে তাদের লোকবল আরও বাড়াতে হবে। এছাড়া স্থানীয় পর্যায় থেকে রাজস্ব আয়ের বিষয়ে ভাবতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতকে ট্যাক্সের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই কেবল রাজস্ব আয় বাড়বে।

এদিকে রাজস্ব আয় কম হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ করফাঁকি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় বলা হয়েছে, ফাঁকি ও কর এড়ানোর ফলে এক বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হয় বলে এক গবেষণায় পাওয়া গেছে।

এই ক্ষতির পরিমাণ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও স্বাস্থ্য বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি। ১২টি প্রতিষ্ঠান, ১০ জন সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ, এনবিআরের ২ জন সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মতামত এবং কর এড়ানো ও কর ফাঁকির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে সিপিডি গবেষণার হিসাবটি তৈরি করেছে। উন্নয়ন সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহায়তায় এই গবেষণা পরিচালনা করে সিপিডি।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রাজস্ব ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক খাত। এটি ‘ছায়া অর্থনীতি’, যার প্রকৃত হিসাব করা কঠিন। এসব খাত থেকে এনবিআর কর আদায় করতে পারে না। অনানুষ্ঠানিক খাতের কারণে ২০১০ সালে কর ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এরপর প্রতিবছরই এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। ২০২১ সালে এসে তা ৪ গুণ বেড়ে ৮৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা হয়েছে। আমরা অনুমান করছি, কর ফাঁকির একটি অংশ পাচার হয়। কিছু অংশ বিনিয়োগ হয়। আবার কিছু অংশ প্রতিষ্ঠানের সম্পদের মধ্যে থাকে।

এদিকে রাজস্ব আয়ে ঘাটতি হওয়ায় ব্যয় মেটাতে ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে সরকার। এতে ব্যাংক খাতের উপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনিতেই তারল্য সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সরকার ঋণ নিয়েছে ৪২ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিয়েছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে পুরো অর্থবছরে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে রেখেছে সরকার। 

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণের বড় অংশ দিয়েছে ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে। অবশ্য গত ৬ মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ অনেকটাই কমিয়ে এনেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কারণ সরকার ঋণ শোধ করে দিচ্ছে। এদিকে তারল্য সংকটের কারণে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহারও বাড়ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //