খেলাপি ঋণ ও রিজার্ভের উল্টোযাত্রা

আর্থিক খাতের দুই সূচক নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। দুটি সূচকই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের উল্টোযাত্রায় রয়েছে। দেশের স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য খেলাপি ঋণ কমানো এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ ক্রমশ বাড়ছে। এছাড়া হিসাবে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণ আরও বেশি, টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ কোটি টাকারও বেশি। অন্যদিকে রিজার্ভ বৃদ্ধির পরিবর্তে ক্রমশ কমে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এই দুটি সূচকে ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। ব্যাংক খাতে নিয়মনীতির জোরদার এবং বৈদেশিক লেনদেনের অর্থপাচার প্রতিরোধ করা দরকার। 

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতি তিন মাস পর পর খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও এই প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। তবে এটি প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র নয়। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) খেলাপি ঋণের এই তথ্য নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। সংস্থাটির মতে, অনেক খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। এর বাইরে আদালতের স্থগিতাদেশের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। এছাড়া প্রকাশিত ব্যালান্সশিট থেকে দিতে খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এগুলোও মূলত খেলাপি ঋণ। এগুলোসহ প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক খুব শিগগির ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০২২ প্রকাশ করতে যাচ্ছে। সেখানে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ দেখানো হতে পারে। যদিও বাংলাদেশ আগের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে ডিসেম্বরে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত অবলোপন করা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা হয়েছে আরও দেড় লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর খেলাপি ঋণের যে হিসাব দেয়, তা যথাযথ নয়। ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর অর্ধেকের মতো বছরের পর বছর ধরে মামলায় ঝুলে আছে। অর্থাৎ যত দিন মামলাগুলো চলবে, তত দিন খেলাপি হিসেবে এগুলোকে গণ্য করা হবে না। একইভাবে অবলোপন করা ৫৫ হাজার কোটি টাকাকেও খেলাপি হিসেবে দেখানো হয় না। এ দুটিকে যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় চার লাখ কোটি টাকার বেশি। ব্যাংকিং খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ’ শীর্ষক এক গবেষণায় আমি দেখিয়েছি, ৭৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে হয়েছে। ২০১০ সালে এ গবেষণা বই আকারে বেরিয়েছে। সরকারের একটা দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে খেলাপিদের লাই দেওয়া, সুবিধা দেওয়া। ২০১৯ সালে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হয়ে আসার পর থেকে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। একটার পর একটা আইনি সুবিধা দেওয়ার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে কিছুদিন আগে ব্যাংক কোম্পানি আইনের পরিবর্তন করে তাদের আরও সুবিধা দেওয়া।

এদিকে সংকটের সময়ও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এখনো ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার বিক্রি অব্যাহত থাকায় রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমেছে। ১৯ জুলাই আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি (বিপিএম৬) অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। এক সপ্তাহ আগে ১২ জুলাই বিপিএম৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ছিল। গত এক সপ্তাহে দেশের গ্রস রিজার্ভে ১২ কোটি ২৮ লাখ ডলার ক্ষয় হয়েছে। আর চলতি মাসের এখন পর্যন্ত রিজার্ভের ক্ষয় ১৩৫ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ গত ২০ জুলাইও রিজার্ভ থেকে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার ও ২০ লাখ ইউরো বিক্রি করা হয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, সাম্প্রতিক বৈদেশিক পরিস্থিতি কিছুটা দায়ী হলেও এই দুই সূচকের অবনতির জন্য মূল দায়ী আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব। ব্যাংকগুলো অনেকটা পারিবারিক লুটপাটের আখড়ার পরিণত হয়েছে। ঋণের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে তা পাচার করা হচ্ছে। আবার ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াতেও অর্থপাচার করা হচ্ছে। এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে কোনো ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি ঋণখেলাপিদের বা অর্থপাচারকারীদের। ঋণখেলাপিরা কোনো বিপদের কারণে ঋণখেলাপি হননি। মামলাগুলোকে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখছেন তারা। তারা সুবিধা নিচ্ছেন এবং কোনো ধরনের নিয়ম মানছেন না। এমনকি খেলাপি ঋণের বেশির ভাগ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দুবাইয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে।  

পিডব্লিউসি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা অংশীদার মামুন রশীদ বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সমস্যা বলতে গেলে শুধু যে মন্দ ঋণের কথাই আসবে তা নয়। জবাবদিহি ও সুশাসনের অভাবও এখানে বড় সমস্যা। সন্ধ্যা ৬টার সময় একটি ব্যাংকের সিন্দুক থেকে বেশ কিছু টাকা বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটি ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং হিসাব থেকে চার কোটি ডলারের বেশি অর্থ বিদেশে চলে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে রিজার্ভ পাচার হয়েছে, হাইকোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও ২৮ বার এবিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ থেকে বিরত রাখা হয়েছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //