বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

তিন মাসে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ১০ ব্যাংকের

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ চলতি বছরের জুনে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ব্যাংকগুলোর অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন খেলাপি ঋণ বাড়ছে তা নির্ধারণে বিশেষ তদারকি জরুরি বলেও মনে করছে সংস্থাটি।

গত সপ্তাহে এক প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, তিন মাসের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। 

এর মধ্যে সবার উপরে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। মার্চ থেকে জুন সময়ে ব্যাংকটিতে ১৩ হাজার ৬৫৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। খেলাপি বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এবি ব্যাংক। আলোচ্য তিন মাসে এক হাজার ৮৮৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা খেলাপি বেড়েছে ব্যাংকটিতে। 

এক হাজার ৬১৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বেড়ে তালিকার তৃতীয় স্থানে আছে ন্যাশনাল ব্যাংক। এরপরে ক্রমান্বয়ে অগ্রণী ব্যাংকের হাজার ৫৫১ কোটি ৯৫ লাখ, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এক হাজার ১২ কোটি ৭৯ লাখ, বেসিক ব্যাংকের ৫৫০ কোটি ১৭ লাখ, ওয়ান ব্যাংকের ৫৪৭ কোটি ৯৯ লাখ, আইএফআইসি ব্যাংকের ৪৭২ কোটি দুই লাখ, সাউথইস্ট ব্যাংকের ৪৬৩ কোটি ৩৩ লাখ, রূপালী ব্যাংকের ৪৫৩ কোটি ৫৭ লাখ, এনসিসি ব্যাংকের ৪৩৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে।

অন্যদিকে ১০টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট খেলাপির দুই তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ এক লাখ কোটি টাকার বেশি। 

রাষ্ট্রয়াত্ত ছয় ব্যাংকের পাঁচটিতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুন শেষে রাষ্ট্রায়াত্ত ৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা বা মোট খেলাপির ২৫ দশমিক ০১ শতাংশ। মার্চ শেষে যা ছিল ৫৭ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে এই ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত তিন মাসে রাষ্ট্রয়াত্ত ছয় ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটিতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ খেলাপি ব্যাংকের তালিকায়ও রয়েছে এ পাঁচটি ব্যাংক। গত জুন শেষে জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৩২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এরপর অগ্রীণ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৪৯৫ কোটি বা মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। এছাড়া বেসিক ৮ হাজার ২৫ কোটি বা ৬২.৬৬ শতাংশে পৌঁছেছে। জুন শেষে রূপালী ব্যাংকের ৮ হাজার ৩৯ কোটি বা মোট ঋণের ১৯.০৬ শতাংশ এবং সোনালীর মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা বা ১৪.৯৩ শতাংশ।

গত জুন শেষ বেসরকারি ৪৩টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। মার্চ শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকে খেলপি ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ

সাম্প্রতিক ওই প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও বলেছে, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে তারা সমস্যায় ভোগা ব্যাংকগুলোর সাথে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে এবং সংকট মোকাবেলায় তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিদর্শন জোরদার করে নিয়মনীতিকে আরও শক্তিশালী করেছে।

এছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রম্পট কারেকশন অ্যাকশন (পিসিএ) সংক্রান্ত নির্দেশিকাও জারি করা বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই নির্দেশিকার জারি হলে, বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঘিরে দ্রুত সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০.১১ শতাংশ।

গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বা ৮.৮০ শতাংশ। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ১ লাখ ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকাই শীর্ষ ১০ ব্যাংকে রয়েছে।

কঠোর আইন প্রয়োগের তাগিদ বিশ্লেষকদের

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসনের চরম সংকট। দেশে আইন থাকলেও এখানে তার কোনো প্রয়োগ নেই। ফলে আর্থিক সংকট আরও গভীর হয়েছে। একের পর এক নীতি সহায়তা দিয়ে এতোদিন ভালো গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। সুবিধা দিয়েও যেহেতু কাজ হচ্ছে না এখন সব ধরনের সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে কঠোর আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিৎ বলে তিনি জানান।

খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না বলে জানিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, খাতা কলমে দেখানো হচ্ছে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে এ অংক অনেক বেশি। কারণ এখানে পুনঃতফসিল ও পুন:গঠন করা ঋণের হিসাব নেই, এগুলো যোগ করলে আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

তিনি জানান, খেলাপি ঋণ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা মানে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। এতে করে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমবে। এতে করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। যা আমাদের কাম্য নয়।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //