ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় ব্যবস্থা কেন নয়

বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবরই বলে আসছে যে, তারা ডলারের দাম নির্ধারণ করে না। বরং দেশের ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপরই ছাড়া রয়েছে। কিন্তু প্রতি ডলারে সরকার নির্ধারিত ১১০ টাকার পরিবর্তে ব্যাংকগুলো আরো বেশি দামে ডলার কিনছে। তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক সম্মতি আছে বলেও জানা গেছে।

বলা হচ্ছে, ডলার-সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন কিছু ব্যাংককে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনার পরামর্শ দিয়েছে। ফলে চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে প্রবাসী আয় আসা কিছুটা বেড়েছে।

যদিও চলতি মাসের শুরুতেই নির্ধারিত দামের তুলনায় বেশি দাম ডলার কেনাবেচার জন্য ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে অনৈতিক কাজ করাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সমস্যা সমাধানে দাম বাজারভিত্তিক করার বিকল্প নেই।

বিনিময় হার ছাড়া হয় না কেন

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, বাংলাদেশ ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের নির্বাহীদের প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) মিলিতভাবে ডলারের দাম নির্ধারণ করে থাকে।

তিনি বলেন, বাফেদা কিন্তু বাজারের ডিমান্ড-সাপ্লাই অ্যাসেস করেই দামটা নির্ধারণ করে। বাফেদা তো হঠাৎ করে কোন বেসিক ছাড়া করে না (দাম নির্ধারণ)। সুতরাং এটা বাজারের পার্টিসিপেন্টরাই নির্ধারণ করে।

তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হলেও প্রকৃত পক্ষে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপর ছাড়া হয়নি। আর এ কারণেই ডলারের একাধিক বিনিময় হার প্রচলিত রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দাম বাজারের উপর ছাড়া নিয়ে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের এক ধরণের স্পর্শকাতরতা আছে। তারা মনে করে একবার দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হলে সেটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ঠিক বলা যায় না। এছাড়া এটা আবার নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে কিনা তা নিয়েও সন্দিহান বাংলাদেশ ব্যাংক।

তিনি বলেন, একটা মিসট্রাস্ট (অবিশ্বাস) বাজারের উপর আছে। তারা মার্কেটকে পুরোপুরি ছাড়ে নাই কোনও দিনই, আর এখনো ছাড়ছে না।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে যে, তারা ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপরই ছেড়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে একটা ভয়ের ব্যাপার আছে। কারণ বাংলাদেশে বাজার নিয়ন্ত্রণ বা এর উপর নজরদারি করা সহজ নয়। ফলে ব্যাংক, মানি চেঞ্জার এবং কার্ব মার্কেটে, ডলারের দাম অনেক উপরে উঠে যাবে। এতে করে যাদের দরকার তারা ডলার পাবে না।

বর্তমানে যে পরিস্থিতি হয়েছে তা অভূতপূর্ব উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একদিকে যেমন দাম নির্ধারণের উপর নিয়ন্ত্রণটা রাখতে চাইছে, অন্যদিকে তেমনি নিয়ন্ত্রণের কারণে বাইরে থেকে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হলে টাকাকে যে পরিমাণ আনুষঙ্গিক সহযোগিতা দিতে হবে, নির্বাচনের আগে হয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি দিতে প্রস্তুত নয়।

বিনিময় হার উন্মুক্ত করতে হলে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, ঋণের সুদের হারের উপর থেকে ক্যাপ তুলে ফেলা বা সুদ হার নির্ধারণ করে না দেয়া।

সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হলে মূল্যস্ফীতি স্বল্প মেয়াদে বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে তা কমে আসবে।

ছেড়ে দেওয়া না হলে কী হবে

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে বাইরে থেকে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হলেও বিনিময় হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপরেই ছেড়ে দেয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজারের চাহিদা বেশি থাকার পরও যদি বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ১১০ টাকায় ধরে রাখে, তাহলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলার আসাটা কমে যাবে। এতে রিজার্ভের উপর চাপ আরো বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া না হলে মূল প্রভাবটিই পড়ে রেমিটেন্সের উপর। নিয়ন্ত্রিত হারের কারণে মানুষ রেমিটেন্স পাঠাতে আগ্রহী হয় না।

তিনি বলেন, বিনিময় হার বাজারের উপর ছাড়া না হলে নতুন বিনিয়োগ যেমন আগ্রহী হয় না, তেমনি যারা এরইমধ্যে বিনিয়োগ করেছেন, তারাও আর মূলধন বাড়াতে চায় না। কারণ ডলারের দামের উপর তাদের আস্থা থাকে না।

যেসব ব্যবসায়ী নানা ধরণের অতিপ্রয়োজনীয় মেশিনারিজ বা বাইরে থেকে কাঁচামাল আমদানি করে তাদের উপরও এর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে। কারণ এলসি খোলার সময় তারা পর্যাপ্ত ডলার পায় না।

এটাই কী একমাত্র সমাধান

মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেয়াটাই বাংলাদেশে ডলার সংকটের একমাত্র সমাধান নয়।

বরং যেসব অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে বাংলাদেশে ডলার বিশেষ করে রেমিটেন্স আসছে সেগুলো বন্ধ করা না গেলে ডলার সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ডলার আসার উপর একটা চাপ অবশ্যই আছে। আর সেটা হচ্ছে হুন্ডি। হুন্ডির কারণেই বিদেশে ডলারে চাহিদা অনেক বেশি বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, এজন্য একটা অ্যাগ্রেসিভ অ্যাকশন নেয়া যায় কিনা এই জিনিসটাকে পুরোপুরি বন্ধ করার জন্য, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি দুই-চার জনকে না ধরতে পারেন তাহলে তো এটা চলতেই থাকবে।

তবে একই সাথে ডলারের বিনিময় হার যদি বাজার দরের কাছাকাছি নিয়ে আসা যায় তাহলে সেটা খারাপ হয় না বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, ডলারের দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হলে ডলার সংকট সমাধানে সেটি সহায়ক হতে পারে। তবে একই সাথে হুন্ডির ব্যবহারও কমিয়ে আনতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //