তীব্র অর্থসংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো

মানুষের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ভল্টে রাখে ব্যাংকগুলো। তাই ভল্ট মানেই টাকার খনি- এমন ধারণা অনেকেরই। তবে এখন বাস্তবতা ভিন্ন। ব্যাংকগুলো তীব্র অর্থসংকটে ভুগছে। নিজের প্রয়োজন মেটাতেই বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার নিচ্ছে অধিকাংশ ব্যাংক। একদিকে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারছে না। অন্যদিকে, বৈদেশিক লেনদেনের প্রয়োজন মেটাতে ডলার কিনতে গিয়ে ভল্ট খালি হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় আমানত সংগ্রহ বাড়ছে না। ফলে তীব্র সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সমাধান না হলে এই সংকট আরও প্রকট হতে পারে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বড় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে পাওনা ৮ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত নগদ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৮৭০ কোটি টাকা। কিন্তু খেলাপিরা ফেরত দিয়েছেন মাত্র ১৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ২ শতাংশ। অপর একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে পাওনা ৬ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। ৬ মাসে নগদ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৬৮৫ কোটি টাকা। খেলাপিরা দিয়েছেন মাত্র ১২ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ২ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে ব্যাংকটির পাওনা ৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। নগদ আদায়ের লক্ষ্য ৩৩৫ কোটি, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আদায় করেছে ৬৫ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ১৯ শতাংশ। শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ছিল ৪ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। আদায়ের লক্ষ্য ৩০০ কোটি, আদায় করেছে ২৬ কোটি; যা লক্ষ্যমাত্রার ৯ শতাংশ। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন ব্যাংকাররা অনেকটা বড় ঋণখেলাপিদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। দয়া করে কিছু দিলে পেল, না দিলে কিছু করার নেই। এ ছাড়া বছরের পর বছর ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতিতে থাকা পুরো খাতের জন্য খারাপ বার্তা। কারণ কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকলে তার আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ওই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থাও কমে যায়। 

ঋণ আদায় হচ্ছে না, আবার বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিতে গিয়ে ব্যাপক চাপে পড়েছে ব্যাংকগুলো। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির দায় মেটাতে মার্কিন ডলার কেনায় অনেক অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।  

সে জন্য নগদ টাকায় রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কেনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে একটিকে অন্যটির কাছ থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে গত ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত (৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন) ৫৩২ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ডলার কেনায় ব্যাংকগুলোর ৫৮ হাজার ৫২০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আর বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরজুড়ে দেশে ডলারের তীব্র সংকট ছিল। চাহিদা অনুযায়ী বাজারে না থাকায় রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করা হয়। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি হয় রিজার্ভ থেকে। 

একদিকে আদায় ও আমানত সংগ্রহ কম, অন্যদিকে খরচ বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে টাকা, তথা তারল্য নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। সংকট কাটাতে সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদেও আমানত নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। তবে সংকটে পড়া শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো ১৫ শতাংশ সুদেও তহবিল সংগ্রহ শুরু করেছে বলে জানা যায়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকঋণের সুদহার যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে আমানতের সুদ। এরপরও ব্যাংকগুলো কাক্সিক্ষত আমানত পাচ্ছে না। ব্যাংকে টাকার টানাটানি সামলাতে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তা বা ধার দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে তীব্র তার‌ল্য-সংকটের পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য। 

অন্যদিকে সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে টাকা ধার করে। এতে বেড়েছে সুদহার। ১ট্রেজারি বিলের সুদহারের ভিত্তিতে এখন ব্যাংকঋণের সুদের হার নির্ধারিত হচ্ছে। যে পদ্ধতিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, সেটাকে বলা হয় স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি নভেম্বর মাসের জন্য স্মার্ট রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো সাড়ে ৩ শতাংশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার বাড়াতে পারে। ফলে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ও তারল্যে টান পড়ায় আমানতের সুদহার বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। সংকটে পড়া কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। এর পরও চাহিদামতো আমানত পাচ্ছে না বেশিরভাগ ব্যাংক। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে মাত্র ৫ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, একই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা।

এদিকে তারল্য-সংকটে পড়ায় শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংককে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অন্য ব্যাংকগুলোকে রেপো বা বিশেষ সহায়তা হিসেবে টাকা ধার দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে ১২ নভেম্বর ১৭ হাজার ৭৭৪ কোটি, ১৩ নভেম্বর ১৩ হাজার ৩৭৭ কোটি, ১৪ নভেম্বর ১৫ হাজার ৪৯৬ কোটি ও ১৫ নভেম্বর ১৯ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা দিয়েছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলার ক্রয় ও সরকারের ঋণের কারণে নগদ টাকায় টান পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে চাহিদামতো নগদ জমা রাখার জন্য এখন আগের চেয়ে বেশি তারল্য সহায়তা দিচ্ছে। আমানতের সুদহার সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তারল্যে চাপ আরও কিছুদিন থাকবে। এই সময়ে নতুন বিনিয়োগ হবে না, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে সার্বিক অর্থনীতিতে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //