আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একের পর এক বেলিয়ে আসছে থলের বিড়াল। এস আলাম গ্রুপের থলেও বিড়ালও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত নানা দুর্নীতির চিত্র দেশের ব্যাংকিং খাতের মাফিয়া হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে এস আলম গ্রুপকে। বিগত সরকারে আমলে ইসলামী ব্যাংকসহ শরীয়াহ বিত্তিক ৬টি ব্যাংক নানাভাবে নিজেদের কব্জায় রাখে চট্টগ্রামের এই বিশাল ব্যবসায়িক গ্রুপটি। নানা কৌশলে নামে বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে কত টাকা নিয়ে গেছে এস আলম গ্রুপ তার কোনো হিসাবও নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাত থেকে এস আলম ও তার পরিবারের ব্যাক্তি প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে কত টাকা ঋণ আছে তা জানতে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় বাংক।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছে। আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে। বিএফআইইউর সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, এস আলম গ্রুপ এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৭ সাল থেকে গত জুনের মধ্যে ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার ৭৯ শতাংশই ইসলামী ব্যাংক থেকে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এস আলমের গ্রুপটি শুধু শরীয়াহ ভিত্তিক ৬টি ব্যাংক দখল করেছে তা নয়- ন্যাশনাল, সোনালী জনতাসহ বেশি কিছু ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সব হিসাব করলে নামে-বেনামে তাদের ঋণের পরিমান ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যার প্রতিটি ঋণ ব্যাংকিং নিয়ম উপেক্ষা করে নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি দেশের ব্যাংকিংখাতে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল তার প্রমাণ এসব ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া।
বিএফআইইউর কর্মকর্তা জানান, এস আলম ও তার পরিবারসহ তাদের ব্যাক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামে কত টাকা ঋণ আছে এবং তাদের ব্যাংকের হিসাবে লেনদেনসহ যাবতীয় সব তথ্য ব্যাংকগুলোর কাছে চাওয়া হয়েছে। ৫ কার্যদিবসের মধ্যে এসব তথ্য দিতে বলা হয়েছে। তথ্য পেলে যাচাই-বাছাই করে যেসব অ্যাকাউন্ট জব্দ বা স্থগিত করা দরকার তা করা হবে।
ব্যাংকগুলো এস আলমের কত টাকা ঋণ আছে ঢাকা পোস্ট এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের কাছে জানতে চাওয়া হলে গভর্নর জানান, তাদের কত টাকা ঋণ এ মুহূর্তে পুরোপুরি তথ্য নেই। তবে ঋণ কত জানা যাবে একটু সময় লাগবে। এ বিষয়ে কাজ চলছে।
এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকও নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। এরমধ্যে ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আর শরীয়াহ ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেবল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের কর্মীরা শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। এরই মধ্যে এস আলম ঘনিষ্ঠ ৬ ডিএমডিসহ ৮ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এস আলমের সহযোগী অন্যরা ভয়ে আর ব্যাংকে ঢুকতে পারছেন না। গত ৬ ও ৭ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার মাধ্যমে ৮৪৮ কোটি টাকা বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় গ্রুপটি।
আওয়ামী লীগের সাবেক রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আত্মীয় মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এস আলম গ্রুপ। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে টানা ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন দুঃশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটে। সরকার পরিবর্তনের পর এস আলম ঘনিষ্ঠরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৬ ব্যাংকের ঋণ বিতরণে গত ১৯ আগস্ট বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংক কৃষি, চলতি মূলধন, সিএমএসএমই, প্রণোদনা প্যাকেজ এবং নিজ ব্যাংকে রক্ষিত এফডিআরের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা দিতে পারবে। এলসি খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ নগদ মার্জিন নিতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ বা সীমাতিরিক্ত বকেয়া স্থিতির নগদ আদায় ছাড়া বিদ্যমান বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়া যাবে না।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : এস আলম ঋণ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh