সময় এখন নোরা ফাতেহির

মেয়েটি যখন স্কুলছাত্রী, তখন তার নাচ দেখে একদিন তার সহপাঠীরা হাসাহাসি করেছিল। এতে বেশ অপমানিত বোধ করেছিল মেয়েটি। সহপাঠীদের সেই উপহাসমূলক হাসাহাসি তার চোখে জলের পাশাপাশি ভীষণ জিদ চাপিয়ে দিয়েছিল মনে। সেই জিদ থেকেই মেয়েটি তার মাকে জানাল সে নাচ শিখতে চায়; কিন্তু মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েটির মা এতে সম্মতি দিলেন না; কিন্তু তাতে কি?

জেদি মেয়েটি সেদিন থেকেই ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপিচুপি ইউটিউবে নিয়মিত নাচের ভিডিওগুলো দেখতে লাগল। আর এভাবে নাচের এই ভিডিওগুলো দেখতে দেখতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই সবার অলক্ষ্যে মেয়েটি হয়ে ওঠে সেরা নাচিয়ে। বর্তমানে গোটা বলিউড বুঁদ হয়ে আছে সেই মেয়েটির বেলি ড্যান্সের যাদুতে। বলছিলাম নোরা ফাতেহির কথা।

নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দিলবার দিলবার গানের দৃশ্যগুলো; যেখানে কোমর দুলিয়ে ঝড় তুলেছেন লাস্যময়ী ও আবেদনময়ী নোরা ফাতেহি। বেলি ড্যান্স দিয়ে মাত করে রাখা বলিউডের এই ক্রেজ নোরা মূলত একজন ইন্দো মরোক্কান বংশোদ্ভূত আর্টিস্ট। ১৯৯২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নোরা ফাতেহি কানাডার কিউবেক সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন। নোরার বাবা ছিলেন মরোক্কান এবং তার মা ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। সেই সূত্রে নোরা ফাতেহির শরীরেও বইছে ভারতীয় রক্ত। 

নোরার শৈশব-কৈশোর যৌবনের পুরোটাই কেটেছে পশ্চিমাদের দেশে। তিনি তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন টরোন্টোর ওয়েস্টভিউ সেন্টেননিয়াল সেকেন্ডারি স্কুল থেকে। সেখান থেকে স্কুল শিক্ষা সমাপ্ত করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য নোরা ভর্তি হন ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। তবে ইউনিভার্সিটির গণ্ডি পেরুনোর আগেই ড্রপ আউট হতে হয় এই লাস্যময়ীকে।

কেননা নোরার সৌন্দর্যটা মসৃণ হলেও তার জীবনটা অত মসৃণ ছিল না। নোরার যখন ১৮ বছর ঠিক তখন তারা বাবা মারা যান। বাবার অনুপস্থিতিতে গোটা পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন নোরা। শুরু করেন অমানুষিক পরিশ্রম।

পরিবারের ব্যায়ভার বহন করতে সেসময় তিনি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করতেন একটি রেস্টুরেন্টে। আবার বিকেলে গিয়ে চাকরি করতেন একটি কল সেন্টারে। জীবন সংগ্রাম ও ব্যস্ততা মানুষকে অনেককিছুই ভুলিয়ে দেয়। মানুষ ভুলে যায় তার স্বপ্নের কথা ভুলে যায় তার শখের কথা; কিন্তু নোরা ভুলেননি।

স্বপ্ন ছিল বলিউডে জায়গা করে নেওয়ার। এতকিছুর মাঝেও নোরা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তার স্বপ্নটাকে। সেই স্বপ্ন পূরণের তাড়না থেকেই তিনি নিজের নাচের ভিডিওগুলো পাঠাতে থাকে বিভিন্ন ভারতীয় এজেন্সিতে। এভাবে দেড় বছর অক্লান্ত চেষ্টার পর একদিন ভাগ্যদেবতা সদয় হন নোরার প্রতি। এক এজেন্সি থেকে ডাক পান নোরা। 

এজেন্সিটির নাম অরেঞ্জ মডেল ম্যানেজমেন্ট। এই সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেই নোরা পা রাখেন তার স্বপ্নের রঙিন দুনিয়ায়। এই অরেঞ্জ মডেল ম্যানেজমেন্টের হাত ধরেই ২০১২ সালে ভারতে আসেন নোরা ফাতেহি। তবে ভারতে পা রেখেই যে আজকের নোরা ফাতেহি হয়ে গিয়েছেন তা কিন্তু না।

ভারতে এসেও টানা দুই বছর সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে নোরাকে। এই দুই বছর তিনি বেশকিছু বিজ্ঞপনের কাজ করলেও কেউ তাকে একটি টাকাও দেয়নি। টানা দুই বছর বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করার পর অবশেষে ভাগ্যদেবতা যেন তার ওপর সদয় হন। নোরা ডাক পান বলিউডে। 

অভিনয় করেন ‘রোর : টাইগার অব দ্য সুন্দরবন’ চলচ্চিত্রে। পরবর্তীতে পরবর্তীতে দক্ষিণী, তেলেগু ও বলিউড মিলিয়ে বেশকিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন নোরা। এগুলোর মধ্যে বাহুবলি দ্য বিগিনিং, শের, স্ত্রী, ডাবল ব্যারেল, মাই বার্থডে সং, ভারত প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তবে নোরাকে রাতারাতি তারকা বানিয়েছে এবং পাদপ্রদীপের আলোয় এনে দিয়েছে যে গানটি সেটি হলো দিলবার দিলবার গান। টি সিরিজ প্রযোজিত এই গানটিতে তিনি যেমন নাচে ঝড় তুলেছিলেন তেমনই ঝড় তুলেছিলেন গোটা ভারতবাসীর মনে। আর এই ঝড়ের উত্তাপ এতটাই ছিল যে ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে সেই ঝড়ে আক্রান্ত হয়েছিল গোটা উপমহাদেশ।

আর এরপর থেকে এ পর্যন্ত বলিউডের সবাই যেটা বিশ্বাস করে তা হলো নোরা আইটেম গার্ল মানেই গান হিট। এরপর আরও অনেক গানে পারফর্ম করেন এই বেলি ড্যান্সার যার অধিকাংশই দেখেছে সাফল্যের মুখ। এদের মধ্যে নাহ, ছোড় দেঙ্গে, ও সাকি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

জনপ্রিয় এই আইটেম গার্ল সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইউটিউবেও রাজত্ব করছেন বেশ রাজকীয়ভাবে। এই মুহূর্তে বলিউডের সেরা ড্যান্সারদের একজন নোরা ফাতেহীর ইনস্টাগ্রাম আইডিতে ফলোয়ার সংখ্যা ছাড়িয়েছে কোটির ঘর। যার ফলে তার সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হয়েছে আরও একটি পালক। আর তা হলো, ইনস্টাগ্রামে ফলোয়ারের মাইলফলক কোটির ঘর পেরুনো মরক্কোর প্রথম ও একমাত্র তারকা হলেন এই নোরা ফাতেহি। তবে এখানেই গল্পের শেষ না।

নোরার প্রতিভার শেষ নেই। নাচিয়ের বাইরে তার আরও একটি পরিচয় হলো তিনি একজন কমেডিয়ানও বটে। নিজের ইউটিউব চ্যানেলটিতে তিনি নিয়মিত কমেডি ভিডিও প্রকাশ করেন থাকেন। ইউটিউবেও তার সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বেশ সমৃদ্ধশালী, তার সাবস্ক্রাইবার দুই মিলিয়নেরও ওপরে। সবমিলিয়ে দেখা যায় সাফল্যের সমুদ্রে নোরা যেন একক আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছেন, যা দেখে নির্দ্বিধায় বলা যায় সময় এখন নোরার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //