খুন হওয়ার বীজমন্ত্র

এখানে অন্ধকার একটা যোগসূত্র

তাজা মলাট মলিন হবার আগেই সমালোচনার ঝুঁকি থাকে। কবিতার বই হলে তো ঝুঁকির পারদ লাফিয়ে বাড়ে। অতিশয়োক্তি কিংবা অনবোধনে তা দিগি¦দিক ভ্রান্তিই ছড়ায়। এ লেখা তাই নিছকই ‘পাঠ-প্রতিক্রিয়া’ বলে বিবেচিত হওয়াটাই সঙ্গত।

অদ্বিত অদ্রি অনন্তর দ্বিতীয় কাব্যপুস্তক ‘এখানে অন্ধকার একটা যোগসূত্র’। পুস্তকের শেষ কবিতার শেষ চরণ, ‘কবিতা বিদায় নিলে- আর তো কিছু বলার থাকে না কারও’। একটি পঙতিতেই নিদানকালের কবি পাঠককে প্রবল একটা ঝাঁকুনি দেন। পাঠকের জবানে কুলুপ আঁটেন। আর আঁছড়ে-দুমড়ে পাঠককে আবারও বাধ্য করেন ফিরে যেতে অন্ধকারের যোগসূত্রের কাছে।

প্রশ্ন জাগে, অদ্বিতের দ্বিতীয় কাব্যপুস্তক কি বাংলা কবিতায় বাঁক বদলের ইশারা? নতুন বাকভঙ্গি? কেবলই জ্যামিতিক গোলকধাঁধা? নিশিপাওয়া-‘ঘোরলাগা জগতের বিস্ময়কল্প? নাগরিক ক্লেদ ও যন্ত্রনার প্রচ্ছায়া? নাকি তিনি সব ছাপিয়ে একালের প্রবজ্যায় মহাকালের দিগন্তস্পর্শী হওয়ার জেদে অস্থির?’ এখানে অন্ধকার একটা যোগসূত্র পাঠ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এসব প্রশ্নের উত্তরসন্ধানই পাঠকের জরুরি দায় হয়ে দাঁড়ায়।

অদ্বিতের ভাষায় জবরদস্তি নেই। গিমিক নেই। মিমিক নেই। আছে নাগরিক ভেল্কিবাজির জগত দেখানোর প্রয়াস। যে ভেল্কিবাজির মুখোশ খুলে উৎকট বাস্তবতাকে তিনি খুলে-মেলে ধরেন। নাগরিক ভেল্কিবাজি নগ্নস্বরূপ পাঠকের উপলব্ধিতে হানা দেয় ‘উন্নতির নানাবিধ মেট্রোরেল’ হয়ে। নাগরিক নির্মাণবিকতার সরল বয়ান তিনি তৈরি করেন ‘রাস্তার ওপর একটা হিউম্যানিটি পড়ে আছে’ বলে।

অদ্বিত বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় সীমাবদ্ধ নন। সীমিত নন। তার বোধের ব্যাপ্তি, ব্যাক্তিক বিরক্তি ও বিবমীষার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের ফাঁপা অস্তিত্বে প্রশ্ন তোলে ‘একটা থেঁতলে যাওয়া মুখ- তার নাম জেনে কী লাভ? তাকে দেখা তো যায়, মৃতের মতো; গোটা রাষ্ট্রই না সে?’ তিনি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক সূত্রের ক্লেদ-ক্লান্তি-ঘৃণাকে উন্মোচন করেন ‘প্রত্যেকেই মেনে নিচ্ছে তার নিজস্ব দগ্ধতা। আর রাষ্ট্র নামক ব্যবস্থা,/সমস্ত আগুনের পিতৃতুল্য সে’ বলে।

অদ্বিত তার দ্বিতীয় কাব্যপুস্তকে অব্যর্থভাবে রাষ্ট্রকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। প্রকাশে ব্যক্তিক হলেও অদ্বিত হয়ে ওঠেন সমষ্টির স্বর, ‘আমি পুড়তে পুড়তে ভাবছি, রাষ্ট্র নামক ব্যবস্থায়/আগুনের সঙ্গে আমাদের/কত পুরনো সম্পর্ক’ কিংবা ‘এই স্বাভাবিক রাষ্ট্রে, আমি প্রতিদিন আমার মায়ের মৃত্যু হাতে নিয়ে ঘুরি।’

রাজনৈতিক অসারতার সমকালে অদ্বিতের প্রকাশ ‘এক সিপ কফি খেয়ে আমার রাষ্ট্র আমাকে খুন করে রেখে/ চলে গেছে উন্নয়নের দিকে’ আমাদের দৈনন্দিনের বেঁচে থাকার উদযাপনে ‘খুন’ হওয়ার বীজমন্ত্র বপন করে যায়। আবার তিনি নিরেট সান্ত¡নার ছলে বলেন, ‘পায়ের দিকে তাকাই, দেখি পরিষ্কার/ মাথার ভিতর তাকাই, দেখি কাদা লেগে আছে’। বুলগেরিয়-ফরাসি দার্শনিক তেভান তোদোরফের দোহাই দিয়ে এ পাঠ-প্রতিক্রিয়ার ইতি টানতে চাই:

‘একজন আলোচক যখন তার সক্ষমতার সবটুকু ঢেলেও কোনো লেখা সম্পর্কে কিছু বলেন, তখনো আসলে তিনি কিছুই বলতে পারেন না। একজন লেখকের পাঠই আসলে শেষ কথা’।

তাই অদ্বিত অদ্রি অনন্তর দ্বিতীয় কাব্যপুস্তক ‘এখানে অন্ধকার একটা যোগসূত্র’ নিয়ে আলোচনা বিস্তার না টেনে, কেবল এ তরুণের লেখা পাঠের আহ্বান জানিয়ে এই আলোচনার শেষ দাঁড়ি দিয়ে দেওয়া যাক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //