কবিতায় রাজনৈতিক মাত্রা সৌন্দর্যের জগৎ

সিদ্দিক প্রামাণিক কবিতা লেখেন কেবলই ইনিয়ে-বিনিয়ে শব্দচর্চার জন্য নয়, বরং তার সমাজ ও পরিবেশে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনার জন্য। আর কবি সিদ্দিক খুব ভালো করেই জানেন যে, এ পরিবর্তন অবশ্যই প্রথমত রাজনৈতিক। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশিত তার কাব্যচর্চায়। এ আকাঙ্ক্ষা দ্রোহীর উচ্চ কণ্ঠে নয়, তীক্ষ্ণ হাস্যশ্লেষের বাণে প্রকাশিত। অতএব, জীবনের জন্য শিল্প, না শিল্পের জন্য শিল্প- এ প্রশ্ন নিয়ে তার কোনো দ্বিধা বা সংশয় নেই। আরও সোজাসাপটা করে বললে কবিতা তার কাছে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাতিয়ার। সেইসঙ্গে তার হাতে এই হাতিয়ার শিল্পিতও বটে। তার কবিতার বই: বাতিল বেশ্যার ডায়েরি, মাতাল মিউজিকে বেসুরো নাচের মুদ্রা, উন্মাদের কনসার্ট, হাঙরের সমুদ্রে মননশীল মাছ, এবং শরীরেও হারমোনিয়াম থাকে। সাম্প্রতিক কবিতার বই শিল্পী সঞ্চয় সুমনের আঁকা ছবির প্রচ্ছদে ‘সতর্ক ছুরির দুপুর’।

তার কবিতায় ঔপনিবেশীকরণের, নির্যাতনের, বন্দিত্বের, আধিপত্যের, বিমানবিকীকরণের ও শোষণের ছবি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। যেমন ‘বুনো দর্শন’ কবিতায় বলেন কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য তার ‘মারমুখী শিং, বিভ্রমের চাহনি আর বিভক্তের খুর নিয়ে আমাদের লোকালয়ে তেড়ে এলো।’ আমাদেরও কণ্ঠস্বর একসময় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বদলে গেল সে অভিঘাতে।

‘যৌনতা’ কবিতায় বলছেন কৃষক-শ্রমিক শ্রমজীবী মানুষের স্বাধীনতা হারানোর কথা। ছাগল আর মোরগের তবু সামান্য যৌন স্বাধীনতাটুকু আছে। আমাদের কেবল চেপে যেতে হয় সমস্ত স্বাভাবিক প্রকৃতি। সবচেয়ে মর্মান্তিক, কেবলই ‘শস্যক্ষেত ও উৎপাদন বিষয়ে কলহ করি, অযথা তর্ক করি চাষাবাদ নিয়ে।’ হারিয়ে ফেলেছি প্রয়োজনীয় ঐক্যের বোধ ও স্বাধীনতাও। পত্রপত্রিকা ও দূরদর্শনের হাতে আমরা কীরকম পুতুল এবং আমাদের জীবনযাপন কীভাবে নিয়ন্ত্রিত তার ছবি ‘সুপারস্টার’ কবিতায়। অমুক সুন্দরী, তমুক সুন্দরী ও সুপারস্টার বানানোর জাদু তাদের হাতে। কবি তাই মন্ত্রটি লিখেছেন এভাবে, ‘ব্যবহারে সমৃদ্ধ হলে একদিন হতেও পার সমানে সমান।’

সমাজে যাপিত বাস্তবতার একটি বড় অংশই প্রচারমাধ্যমের তৈরি। আমাদের সুখ, সংকট, ক্ষোভ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির বড় অংশই প্রচারমাধ্যম ইচ্ছেমতো বাজারজাত করে। আমরা তার দ্বারাই প্রভাবিত হই। ‘প্রচার সর্বস্ব’ কবিতায় তাই ‘বাবু মাইক চন্দ্র বসাক, আমি আর ব্যানার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রচার সর্বস্ব বলেই আমরা বিখ্যাত।’ দিন শেষে মাইক ভাড়ার দোকানে, ব্যানার বগলে ও আমি পানশালায় যাই।

‘ছবি’ কবিতায় দেখতে পাই এ সমাজে ভালোবাসার চেয়ে বেশি টাকার শক্তির পরিচয়। কবি তাই ফেসবুকে তার প্রিয়তমার ছবি দেখেন যে বিয়ে করেছে তার চেয়ে অনেক বয়স্ক এক টাকাওয়ালাকে। তরুণী বধূর আপাত পরম সুখ ফুটে ওঠে তার পাশে তোলা গাড়ি, পোষা কুকুর ও বিড়ালের ছবি থেকে। সেই ছবির মেলায় শুধু একটি লোকের অনুপস্থিতি থেকে ফুটে ওঠে তার গোপন দুঃখটিও। ‘খচ্চর বংশীয়’ কবিতাটিতেও দেখা যায়, এ সমাজে বিয়ের বাণিজ্যিক রূপ। ‘কবি ও কুকুর’ কবিতায় তার ঘৃণা সেইসব শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি প্রচলিত বিয়ের মতোই সাহিত্যচর্চাও যাদের কাছে পুরস্কার ও পদকের বাণিজ্য মাত্র- ‘কুকুর নিধন অভিযানকালে পোষা কুকুরের গলাতেও পরাতে হয় পদকের মতো শনাক্তকরণ চিহ্ন।’
মধ্য ও নিম্নবিত্ত জীবনের কষ্ট ও সংগ্রামের ছবি তার বেশিরভাগ কবিতায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তবে শ্লেষের ভঙ্গিতে প্রকাশিত। স্বাধীনতা, মুদি, হাংরি পাখি, পরিবার, ভাড়া বাসা, ফাও, সতর্ক ছুরির দুপুর, নতুন মহাদেশ, বিড়াল, গোপন পাহারা, স্বপ্ন এরকই কয়েকটি কবিতা যা এগুলোর শিরোনাম থেকেও অনেকটা বোঝা যায়। ‘অমোচনীয়’ কবিতায় যেমন, ‘লোক ঠকাতে ঠকাতে গো-হাটের দালালও একদিন ঠিকই ঠকে যায় সামান্য পকেটমারের কাছে।’ আবার ‘তার কাছেই গেলেই’ কবিতায় দেখি আরও মর্মান্তিকভাবে ‘এই সামান্য শোয়াশুয়ির পরেই ঘরে আসবে-দুধের কৌটো, চাল, ডাল নিত্য উপকরণ।’

সিদ্দিক প্রামাণিকের প্রতিটি কবিতায় একটি স্পষ্ট বক্তব্য আছে। হেঁয়ালি, বুদ্ধিবাজি, অর্থহীন রহস্যময়তা ইত্যাদির জন্য তিনি কবিতা লেখেন না। আর বক্তব্যকে পাঠকহৃদয়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিদ্রূপ, কৌতুক ও শ্লেষ তার কবিতায় খুবই ব্যবহৃত দক্ষ উপায়। যৌনতা আরেকটি বহুল ব্যবহৃত উপকরণ। মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনে নারীপুরুষের মিলন তার শব্দশিল্পের ছোঁয়ায় ভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক অর্থে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, যেমন ‘কর্মজীবী মেস’ কবিতায়-
একটা সরলরেখার ওপর আরেকটি সরলরেখা
দণ্ডায়মান হলে কিছুটা কেঁপে উঠত
সস্তা কাঠের চৌকি।
কবি সিদ্দিক কথা বলেন শান্ত; কিন্তু ব্যঙ্গাত্মক ঢঙে। বেদনা ও ক্রোধ যেন তাকে ছুঁতে পারে না, সেসব তিনি তীর হিসেবে ছুড়ে মারেন সমস্যার সামাজিক উৎসের দিকে। তার কণ্ঠ কখনো উচ্চগ্রামে যায় না। কণ্ঠ যেন সংবাদপাঠকের মতো নির্লিপ্ত; কিন্তু বিবরণের মধ্যে একটা কাব্যিক কারসাজি থাকে, যা শ্রোতাকে চমকে দেয়। ‘কীটনাশক’ কবিতায় যেমন ‘কীটনাশক ছিটাতে ছিটাতে’ দরিদ্র কৃষকের বাম্পার ফলনের স্বপ্ন; কিন্তু ‘হঠাৎ খবর এলো-কীটনাশকের বাকিটা খেয়েই মর্গে শুয়ে আছে তার অসুখী বউ।’
তার কবিতা একেকটি ছোট ছোট গল্পের মতো। আবেগের বিস্ফোরণ নেই, প্রতিবেদকের নিস্পৃহ ভঙ্গিতে ঘটনার বিবরণ; কিন্তু শেষ হয় এক নাটকীয় ঝাঁকুনি দিয়ে। তাতে থাকে কোনো গূঢ় সত্যের উন্মোচন। সেই হচ্ছে তার বর্ণনার ক্ষমতা। ‘স্বপ্ন’ কবিতায় যেমন বলেন-
ক্ষুধাপেটে ভাবি-আমার জন্য অপেক্ষা করছে
বিদেশি কোনো রাজার মেয়ে
যে কিনা ছুটে আসবে উড়ন্ত ঘোড়ায়
পরিত্যক্ত আস্তাবলে শুয়ে মনে পড়ে যায়-
ঘোড়াদের কোনো ডানা নেই, থাকে না কখনো।
 ‘শামুক’ কবিতায় মধ্যবিত্তের ভান, সংকীর্ণতা, অসন্তুষ্টি ও আত্মরতির কথা চমৎকারভাবে প্রকাশিত এ কয়টি বাক্যেই-
 যে মুখ বাড়িয়ে ধরি আসলে তা ছাঁচের মুখোশ
নাখোশ আমি নিজেকে নিয়ে
ঘড়াটা খালি তাই বেশি তালির মতো বাজি
মধ্য-নিম্ন মধ্যবিত্ত ও কর্মজীবী মানুষের জীবনে সাম্প্রতিক করোনাসংকটের আঘাত ফুটে উঠেছে তার ‘চাকরি’, ‘ফিলিংস মাস্টার’ ইত্যাদি কবিতায়। ‘ক্রীতদাস’ কবিতায় আধুনিক কালের ‘হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত ক্রীতদাস’-
মৃত্যুর চেয়ে মালিকের আদেশ বড়
তাই ময়মনসিংহ থেকে হাঁটতে হাঁটতে
ঢাকায় আসছেন গার্মেন্টসের শ্রমিক
খাদ্যের খোঁজে, দলবদ্ধ পিঁপড়ের মতো।
কবি সিদ্দিক প্রতিদিনের সংগ্রামী জীবন ও এ জীবনযাপনকারী ব্যক্তি মানুষগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। দৃষ্টি ফেলেন গভীরে এবং আবিষ্কার করেন ভিন্ন সত্য। খুব সহজে সাবলীলভাবে শিল্পের আঙিনায় তুলে আনেন যৌনতা, যন্ত্রণা, ভান, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্রতা, সংঘাত ইত্যাদি, যা আবার কাব্যিক কৌশলে নির্দেশ করে সৌন্দর্য, শান্তি, স্বাধীনতা ও মানবতার বিজয় রথযাত্রার দিকে। সিদ্দিক প্রামাণিকের কবিতা পাঠে তাই পাঠিকা-পাঠক পাবেন যন্ত্রণাময় জীবনে রাজনৈতিক মাত্রাসমৃদ্ধ অন্য এক সৌন্দর্যের জগৎ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //