রোহিঙ্গাদের জীবনের কাহিনী

‘চোখের সামনে নিজের ভাই-ভাবি, রুকাইয়ার বাবা-মাকে খুন হতে দেখেছিল সে। ওরা তখন মাঠে কাজ করছিল, ফজলও ছিল ওদের সঙ্গে। বলা নেই কওয়া নেই কোথা থেকে হঠাৎ আর্মির লোকেরা এসে বন্দুক তাক করে গুলি চালিয়ে গেল, যতক্ষণ না মানুষগুলো মারা যায়’ 

“মাইয়াফোয়া’র কহন” গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পে রুকাইয়ার চাচা ফজলের জবানিতে ওপরের ঘটনার বিষয়ে আমরা অবহিত হই। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মায়ানমার সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন অঞ্চলে সামরিক হামলা শুরু করে। ফলে অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে ১০ লাখের ওপর রোহিঙ্গা সবকিছু ফেলে কেবলমাত্র জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। 

মাইয়াফোয়া’র বহন

ফাহমি ইলা

গ্রন্থিক প্রকাশন

প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২১

মূল্য : ২৮০


ফাহমি ইলার এটি প্রথম গল্পগ্রন্থ। বইটিতে ছয়টি গল্প আছে। ভূমিকা পাঠ করে আমরা জানতে পারি- গল্পগুলো লেখকের অভিজ্ঞতাজাত বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে রচিত। লেখক কক্সবাজার-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১৮ মাস কাজ করেছিলেন। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ঘিরে। গ্রন্থের গল্পগুলো তাই একইসঙ্গে ‘সৃজনশীল বাস্তবতা’ হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়; কিন্তু যেহেতু এটি গল্পগ্রন্থ তাই এর পাঠপ্রতিক্রিয়াটি বাস্তবতার বিচারে নয়, সৃজনশীলতার নিরিখে দেখা হবে।

বইটিতে স্থান পাওয়া প্রতিটি গল্পের একটি করে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে। তবে শিরোনাম পড়ে গল্প সম্পর্কে ধারণা করা যায় না। মূলত গল্পের ভেতর থেকে এক বা একাধিক শব্দ তুলে এনে শিরোনাম সাজানো হয়েছে; কিন্তু প্রতিটি গল্প ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে উপস্থাপন করে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পাচার, ধর্ষণ, প্রেম, লিঙ্গ বিভাজন, যৌন নির্যাতন, যৌন ব্যবসা, ধর্মান্ধতা, চাকরিরত নারী কর্মীদের ওপর পুরুষ সহকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা ও সমাজের চাপ এবং যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ এসব বিষয় গল্পচ্ছলে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশের সমাজে বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আত্মীকৃত হওয়ার সংগ্রাম গল্পগুলোতে জায়গা পেয়েছে।

প্রথম গল্পে ‘করিম মাঝির বয়স পঞ্চাশের ওপর, ঘরে দুই বৌ আর এগারোটি ছেলেমেয়ে। আবার তার বিয়ের সখ হয়েছিল। বিয়ের যোগ্য মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।’

মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শিক্ষা থেকে শুরু করে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত সব থেকে পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী। বহুবিবাহ তাদের মধ্যে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিশেষ করে ছেলেশিশু জন্ম দেওয়াকে দেখা হয় পারিবারিক ও সামাজিক শক্তিবৃদ্ধির প্রধান উপায় হিসেবে। ‘অধিক ছেলে সন্তান শক্ত সামাজিক অবস্থান’- পিতৃতান্ত্রিক এই ধারণাটি এভাবেই বিকশিত হয়ে আছে তাদের মাঝে। সে কারণেই একাধিক বিবাহ অধিক সন্তানের নিশ্চয়তা বিধায়ক। করিম মাঝির বয়স পঞ্চাশ হলেও ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে সামাজিক বাধা নেই। ধর্মেও এর অনুমোদন আছে। 

পঞ্চাশোর্ধ করিম মাঝির লালসার চোখ পড়ে কিশোরী রুকাইয়ার ওপর। এই চোখ চিরচেনা সেই পুরুষের চোখ, যে চোখ নারীকে ভোগ্যপণ্য ছাড়া আর কিছু ভাবতে শেখেনি। নিজ ভূমি থেকে পালিয়ে এসে সেই স্বজাতির সদস্যের নিপীড়ন ও যৌন সহিংসতার মুখোমুখি রুকাইয়া। ভীতসন্ত্রস্ত রুকাইয়া কি পেরেছিল নিজের মর্যাদা রক্ষা করতে? 

দ্বিতীয় গল্পে ‘তৃতীয় গ্রামটা পার হওয়ার আগেই শরিফা আর্মির হাতে ধরা পড়ে। এরপর টানা দশবার ধর্ষণ শেষে যখন আর্মিরা বুঝতে পারে শরিফা মারা গেছে, তখন তাকে তারা সেভাবেই ফেলে চলে গিয়েছিল। ... নদীর ঘাটে লাখ লাখ মানুষের মিছিলে নেহাতই কপালের জোরে শরীফার স্বামী আমিন তাকে খুঁজে পেয়েছিল। কোলে মেয়েকে নিয়ে সে শরিফার নেতিয়ে পড়া মাথাটি বুকে টেনে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছিল। সে কান্না দেখবার কেউ ছিল না সেদিন। ...’

স্বাভাবিক সময়ে আমিন কি মেনে নিতে পারতো ধর্ষিতা শরিফাকে? কিংবা আমিনের পরিবার ও পশ্চাৎপদ সমাজ? 

আমিন-শরিফা আর তাদের শিশুকন্যা করিমা নাফ নদী পেরিয়ে ক্যাম্পের নতুন ঠিকানায় জীবন শুরু করে; কিন্তু তাদের এই ঠিকানাটিও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ছোট্ট শিশু কন্যা করিমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার প্রতিবাদ ও বিচার চাওয়ার মাসুল দিতে হয় তাঁদেরকে। আমিনের শুভাকাক্সক্ষীর জবানে বিষয়টির বাস্তবতা এভাবে ধরা পড়ে - 

‘শোন, তারা এক-দুই-তিন দিন আমাদের নিরাপত্তা দেবে। এরপর যখন স্বাভাবিক হবে, তখন সেলিম মাঝি প্রতিশোধ নেবে। তখন কী করবি? সিআইসি, আর্মি, এনজিও কেউ কি মাঝরাতে তোকে বাঁচাতে আসবে? আসবে না। ক্যাম্পে ফেরত যাবার আশা বাদ দে’।

তৃতীয় গল্পটি আয়েশা-করিমের প্রেম ও বিয়োগান্তুক ঘটনার আখ্যান। আর্মির হাতে খুন হওয়া পিতা-মাতার রক্তস্মৃতি সঙ্গে নিয়ে ছোট বোনের হাত ধরে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আয়েশা। ঘটনাক্রমে পিতার চাচাতো ভাই আমিনের দেখা মেলে তাদের। আমিন ওদেরকে নিজের মেয়ে পরিচয় দিয়ে নিবন্ধন করিয়ে নেয়। ক্যাম্পে আসার পর সদ্য তরুণী আয়েশার পরিচয় হয় যুবক করিমের সঙ্গে। ওই পরিচয় একসময় পরিণত হয় গভীর প্রেমে। ওদিকে চাচা আমিন মালয়েশিয়ায় বসবাস করা এক বয়স্ক সচ্ছল রোহিঙ্গা পুরুষের সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা চুক্তিতে আয়েশার বিয়ে ঠিক করে। মালয়েশিয়ায় থাকা অন্য আরেকটি পুরুষের সঙ্গে ৩০ হাজার টাকা প্রাপ্তির বিনিময়ে আয়েশার ছোট বোনেরও বিয়ে ঠিক হয়। এ দিকে আয়েশা-করিমের সম্পর্কের বিষয়টি চাচা আমিন জেনে ফেলেন। পরবর্তীতে আরও জানা যায়, আয়েশা গর্ভবতী। আমিনের লোভী চোখ টাকার দিকে। বিয়ে দিয়ে ওদেরকে মালেশিয়া পাঠাতে পারলে টাকাগুলো সে পাবে। যে টাকা দিয়ে সে বিয়ে করার স্বপ্ন সাজাচ্ছে অনেকদিন ধরে। এ রকম জটিল সমীকরণ নিয়ে গল্পটি এগোতে থাকে। আয়েশার পেটের সন্তানের কী হয়েছিল? মালেশিয়া থাকা পাত্রদ্বয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে তাদের দুইবোনকে কি মালেশিয়া যেতে হয়েছিল? নাকি ট্রাজেডির শেষে আয়েশা-করিমের প্রেমের কাহিনি সুখী সমাপ্তির দেখা পেয়েছিল? 

চতুর্থ গল্পটি মায়ানমার আর্মি দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভধারণ করা ১৩ বছরের কলিমা, সিআইসি (ক্যাম্প ইনচার্জ সরকারি আমলা) ও এনজিও কর্মী শায়লার বৈরী সম্পর্ককে ঘিরে।

...এখানে আসার পর যেসব বাচ্চা ধর্ষণের ফলে জন্ম নিয়েছে, অনেক বাচ্চাকেই নাকি জন্মের পরপরই গোপনে মেরে ফেলা হয়েছে। কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। ‘জারজ’ শিশুর ভার বহন করতে চায় কয় জন!’। 

এ ছাড়া ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়া নারীর স্বামীর স্বীকৃতি না থাকায় ও অনাগত সন্তানের পিতৃপরিচয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় রোহিঙ্গা সমাজ শিশুটি ভূমিষ্ট হওয়া মাত্র তাকে হত্যা করে ‘পাপের’ কবল থেকে নিজেদেরকে ও ধর্মকে সুরক্ষা দিতে পছন্দ করেন। 

পঞ্চম গল্পে এমন একটি ঘটনার কথা আমরা জানতে পাই- যেখানে একজন আর্মি সদস্যের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় একটি শিশু। শিশুটিকে কেবল হাসপাতালে যেতে বাধা দেওয়া হয়নি, পরবর্তীতে জানা যায় শিশুটিকে তারা হাসপাতাল থেকেই গুম করে দিয়েছে। শিশুটির ভাগ্যে শেষে কী হয়েছিল সেটি না হয় গল্পটি পাঠ করেই আমরা জানার চেষ্টা করব; কিন্তু এটি তো পরিষ্কার দুর্বলের ওপর সবলের ক্ষমতার প্রতাপ সর্বত্র বিরাজমান। ভাগ্যবিড়ম্বিত, আশ্রিত, নাগরিক পরিচয়বিহীন রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে ওই বিপুল ক্ষমতার ব্যবহার নিরঙ্কুশ ও জবাবদিহিহীন। 

‘পুরো শহরে এমন একজন মুসলিম নারী খুঁজে পাইনি যে বোরখা পরেনি। যে কয়জন পরে না তারা ভিন্ন ধর্মের নতুবা এনজিওর কর্মী। এ শহরে পা দিয়ে নীলার মনে হয়েছিল, সে অন্য কোনো দেশে চলে এসেছে। প্রথমদিকে বাজারে গেলে তার দিকে স্থানীয়রা অদ্ভুত চোখে তাকাত। সে শুনেছে, একটি মেয়ে যে কোনো এক এনজিওতে কাজ করত, সে মাথায় কাপড় না দিয়ে বাজারে যাবার কারণে তাকে অপমান করবার জন্য ডিম ছুড়ে মারা হয়েছিল। মেয়েটি পরের সপ্তাহে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে কক্সবাজার চলে যায়’। 

উপরের উদ্ধৃতি চিহ্নের কথাগুলি গল্পের নীলার। নীলা একজন এনজিও কর্মকর্তা। চাকরি সূত্রে তিনি দেশের সর্বদক্ষিণের টেকনাফে থাকেন কিছুদিন ধরে। নীলার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা আরও জানতে পারি, টেকনাফের মাদক চোরাচালানের কথা। কেবলমাত্র নারী হবার কারণে সন্ধ্যার পর জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শের কথা বলতে শুনি নীলার বিদেশি বসের কাছ থেকে। 

ষষ্ঠ গল্পটি জাতিসংঘের একটি অঙ্গ সংস্থায় কাজ করা সিনিয়র চাইল্ড প্রটেকশন স্পেশালিস্ট মিতার। জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও মিতাকে তারই সহকর্মী ইয়াসিনের যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা ও অবমাননাকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। মিতা মুখ বুজে থাকে না। সে এর বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দপ্তরে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করে অপেক্ষায় থাকে প্রতিকারের আশায়। অবশেষে সংস্থার সদর দপ্তর একদিন একটি ই-মেইল আসে মিতার কাছে। ওই ই-মেইলে কি মিতার কাঙ্ক্ষিত প্রতিকার পাওয়ার অপেক্ষা ফুরিয়েছিল? এভাবে গল্পটি পরিণতির দিকে এগোতে থাকে।

প্রথম তিনটি গল্পের টুইস্ট পাঠককে নিশ্চয়ই মোহিত করবে। তবে গল্পগুলো অতিমাত্রায় বর্ণনাত্মক হওয়ায় উপমা, রূপক ইত্যাদি সাহিত্যরসের অভাববোধ করেছি। চরিত্রগুলোর ভেতরে প্রবাহিত অনুভূতির গভীর তলদেশের দেখা পাইনি। গল্পগুলোর কাহিনির রুঢ় বাস্তবতা হয়তো লেখককে যা কিছু বলার তা সোজাসুাজি বলে দেওয়ার তাড়নায় তাড়িত করেছে।  

“মাইয়াফোয়া’র কহন” রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ক্যাম্পের জীবন আলেখ্য। যে জীবন সম্পর্কে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের জানাশোনা ও বোঝাপড়া নেই বললেই চলে। সেই ১৯৭০ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে মায়ানমার সরকারের জুলুম-নির্যাতন থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ও তার কয়েক দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আলোচ্য গল্পগ্রন্থে ১০ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা জীবনের অসংখ্য গল্পের মধ্যে অল্পকিছু ঘটনার সাহিত্যিক নির্মাণ। লেখকের সহজ ও সাবলীল গল্প বলার ঢং এবং গল্পের গতি পাঠককে পরের পৃষ্ঠায় নিয়ে যাবে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশে সম্ভবত ইতিপূর্বে গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। সে হিসেবে রোহিঙ্গা নারীদের জীবনের ঘটনার আলোকে লেখা প্রথম গল্পগ্রন্থ- ‘মাইয়াফো’র কহন। বইটি এবারের বইমেলায় আপনার গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ হবে নিঃসন্দেহে এবং একটি নির্যাতিত ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর নারীদের কাহিনির পাঠ হবে নতুন কিছু জানার অভিজ্ঞতার আনন্দে ভাস্বর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //