মান্টোকে আফসানে

বহুল চর্চিত ও সমালোচিত ‘কালো শেলোয়ার’ গল্প রচনার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ১৯৫২ সালের অক্টোবরে করাচির আদালতে উপস্থিত হয়ে বিচারের রায়ে পঁচিশ টাকা জরিমানা দিয়ে অব্যাহতি পান তিনি। পরে সেদিন বিকালেই করাচির মেরিনা হোটেলে এক সভায় তিনি বলেন, ‘হে খোদা! সাদত হাসান মান্টোকে তুমি এই পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নাও। আলোর মধ্যে যে চোখ মেলে না; কিন্তু অন্ধকারে ধাক্কা খেয়ে বেড়ায়।

লজ্জার আবরণীর প্রতি তার কোনো কৌতূহল নেই, কারণ সে দেখে মানুষের নগ্নতা। গৃহবধূদের দিকে সে চোখ তুলে তাকায় না; কিন্তু যৌনকর্মীদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলে। যেখানে কান্না সেখানে সে হাসে, যেখানে হাসি সেখানে কাঁদে। কয়লার দালালি করে যারা মুখ কালিমালিপ্ত করে, সে তাদের কালিমা দূর করে স্বচ্ছ চেহারা সবাইকে দেখায়।

তাই এ ধরনের দুষ্কৃতকারী, অপ্রিয়ভাজন ব্যক্তিকে তুমি তুলে নাও। কারণ সে এ পৃথিবীর অসৎভাব দুর্বৃত্তদের আমলনামার কালিমা মুছে ফেলার কাজে লিপ্ত রয়েছে।’ 

বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মান্টো-সাহিত্যের আদর্শ, তাঁর চিন্তা ও নৈতিক সত্যতার অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। নিজের সময় থেকে বহুকাল সামনে এগিয়ে যাওয়া চরম উন্নাসিক, উদ্ভ্রান্ত আর বোহেমিয়ান জীবনের লেখক, উর্দু ছোটগল্পের এক মুকুটহীন নবাব হয়ে উঠেছিলেন নিজে।

যেখানে তার বাহ্যত অস্তিত্বের যাপনে ছিল প্রগাঢ় বেদনাবোধ আর জীবনের অপরিমেয় দৈন্য। অথচ আপন সৃষ্টির সমস্তজুড়ে বিছিয়ে দিয়েছিলেন এক অলৌকিক ঐশ্বর্যময়তা। বহুকালের বিসর্প গল্পের চিরায়ত সমুদয় ধারা চুরমার করে জন্ম দেন এক স্বাতন্ত্র্য ধারার। যেখানে মানবজীবনের সবচেয়ে অচ্ছুত, নোংরা, খারাপ ও অপ্রকৃষ্ট মনে করা সেসব পতিতা, গণিকালয়, বেশ্যার দালাল, দণ্ডার্হ, মেথর, চাকর আর সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের জীবনের নিগূঢ় বাস্তবতা ও অন্তর্দাহ শোকগাথার কথা তুলে ধরেন এক আশ্চর্য বুননকৌশলে।

যেসবে মান্টো তাঁর পাঠককে এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, এই নিন্দার্হ, অযশস্কর ও কলঙ্কিত লোকেরাও তোমাদের মতোই মানুষ। অধিকন্তু ওসব ভণ্ড, ধড়িবাজ ও ধূর্তদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ- যারা তাদের ব্যর্থতাকে ভণ্ডামি ও কপটতার আবরণে ঢেকে রাখে। 

লেখকের অধিকাংশ রচনাই আত্মজৈবনিক এবং তাঁর আপন দ্বৈত সত্তার অন্তর্গূঢ় বিভক্তিই প্রতিফলিত করে। ফলে কল্পিত নয় বরং প্রকৃত যে বাস্তবতা, যে যাতনাবোধ, যে স্পর্শকাতরতা, হীনতা ও কপর্দকশূনত্যা- সূক্ষ্ম হৃদয়ের মান্টোকে এমনভাবে আহত করেছে, শিল্পী মান্টো তা থেকে জন্ম দিয়েছেন একেকটি নতুন আখ্যানের।

মান্টো তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাতটি পেয়েছিলেন দেশ ভাগে। যে দেশ, যে শহর, যে মাটির গন্ধে তিনি বেড়ে উঠেছেন, বাপ-দাদার শরীরের ঘ্রাণ যে বায়ুর অম্লান প্রবাহে- দেশ ভাগের নির্মম রাজনীতিতে হঠাৎই সে দেশ, সে শহর ও আপন মাতৃভূমি ত্যাগ করে তাকে যেতে হয় একেবারেই অচিন, সদ্য ভ‚মিষ্ঠ নতুন এক শহরে।

যেখানে ইতিপূর্বে সমস্ত জীবনে মাত্র কয়েকবার এসেছিলেন তিনি। ’৪৭-এ বিভাজনের পর এক পৃথিবীসম বিষাদ আর হৃদয়ভরা যন্ত্রণা নিয়ে ১৯৪৮ সালে মান্টো বোম্বে ছেড়ে লাহোরে চলে যান। যে ব্যথা ও আত্মবেদনার কথা অজ্ঞাত এক শ্যাম চাচাকে লেখা তার আইকনিক চিঠিতে উল্লেখ করেন।

তিনি লেখেন- ‘আমার নাম সাদত হাসান মান্টো এবং আমি এমন এক স্থানে জন্মেছি, যা এখন ভারতে। যেখানে আমার মায়ের কবর, আমার বাবার কবর, এমনকি আমার প্রথম সন্তানটিও সে মাটির নিচেই শুয়ে আছে। যদিও সেই জায়গাটা এখন আর আমার দেশ নয়।

আমার দেশ এখন পাকিস্তান; যেখানে ব্রিটিশ শাসনে থাকাকালীন মাত্র পাঁচ-ছবার এসেছিলাম আমি।’ দেশত্যাগী এ অমর গল্পকার মান্টোর উর্দু ভাষা থেকে ভাষান্তরিত ৫০ গল্পের সংকলন- ‘মান্টোকে আফসানে’। অনুবাদক কাউসার মাহমুদ উর্দুভাষা থেকে নিজস্ব দক্ষতায় মান্টোর চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন বাংলা ভাষাভাষী সকল পাঠকের কাছে। সুদৃশ্য এ গ্রন্থটি পেণ্ডুলাম প্রকাশনের একটি আলোচিত প্রকাশনা। 

লেখক: সাদত হাসান মান্টো

ভাষান্তর: কাউসার মাহমুদ

প্রচ্ছদ ভাবনা: মিথুন রশীদ

প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২২

প্রকাশন: পেণ্ডুলাম পাবলিশার্স

দাম: ৮৫০ টাকা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //