পূর্ববঙ্গ বাম রাজনীতির তাত্ত্বিক আখ্যান

বিমল বিশ্বাসের লেখক হওয়ার কোনো বাসনা ছিল বলে মনে হয় না। তিনি কলম ধরেন অনেকটা সামাজিক ও রাজনৈতিক তাগিদে। আবার এ কথাও ঠিক যে তিনি কোনো স্বনামধন্য মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ছিলেন না, ছিলেন মূলত অ্যাক্টিভিস্ট- মাঠে ঘাটে ঘুরে কাজ করতেন। স্বভাবতই তিনি তার লেখা শুরু করেন সম্পূর্ণ আত্মকথনের স্টাইলে, কিন্ত দেখা গেল তার অভিজ্ঞতা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির ফলে গোটা রচনাটি শেষ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট রাজনীতির এক উৎকৃষ্ট তাত্ত্বিক আখ্যানে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ শুধু যা দেখেছি, আর যা করেছিতে সীমাবদ্ধ নেই। বস্তুত এই বাড়তি উপাদানটিই তার বইয়ের আসল সম্পদ। ঠিক ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের সন্ধিক্ষণে যশোর জেলার নড়াইলের গোবরা গ্রামে যেখানে লেখকের জন্ম; সেখানে তখনো জাতপাতের বৈষম্য ছিল প্রবল। একদিকে ছিল ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ইত্যাদি উচ্চবর্গীয় হিন্দু ও তার বিপরীতে এক সারিতে নিম্নবর্গীয় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়। এমনকি চিত্রা নদীতে স্নানের জায়গাও ছিল ভাগ করা। নিম্নবর্গীয় হিন্দু হওয়ার সুবাদে বিমল বাবু অবাধে মুসলিমদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পান। তিনি বাম রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার উপযুক্ত কিনা তা পরীক্ষার জন্য উপস্থিত ছিলেন ওই অঞ্চলের কৃষক নেতা হেমন্ত সরকার। পরীক্ষায় তিনি সহজেই উত্তীর্ণ হন। কেননা দরিদ্র ও সর্বহারার আশা আকাঙ্ক্ষা ছিল তার সহজাত জ্ঞান। 

কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙনের সময় তিনি ছিলেন নড়াইল কলেজের ছাত্র নেতা। অর্থাৎ এই বিপর্যয় ছিল তার নাগালের বাইরে। তবু তিনি তার রচনায় পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো এই ঘটনার জন্য অকপটে তার গভীর বেদনা প্রকাশ করেছেন। বিমলবাবু লিখেছেন-
বিনয়ের সাথে বলতে চাই ষাটের দশকের বিভক্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এড়িয়ে যাওয়া যেত। মস্কো পিকিং উভয়পক্ষের তত্ত্ব, তথ্য এবং আমার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আমাকে যা শিখিয়েছে তা হল, এই ভাঙন অপরিহার্য ও যথার্থ ছিল না। এই বিভক্তি এড়িয়ে যেতে পারলে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন ও আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সর্বনাশা ও বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে অদ্যাবধি দিন কাটাতে হত না (পৃ. ৮৫)। 

বিমলবাবুর আগের পূর্ববঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে তার পূর্বসূরি লেখকরা আর কেউ এমন সরল ও মুক্ত কণ্ঠে নিজেদের ভ্রান্তি স্বীকার করেছেন বলে মনে পড়ে না। 

দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশি, প্রায় এগারো হাজার। কিন্তু বিভাজনের পর হিন্দুদের অভিবাসনজনিত কারণে ’৫২ সালের মধ্যে সংখ্যাটি নেমে ২৫০-৩০০ হয়ে যায়। যারা তারপরও থেকে গিয়েছিলেন এবং তাদের সঙ্গে আরও কিছু মুসলিম কর্মী যোগ দিয়ে আবার পার্টি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। সংখ্যার নিরিখে পার্টি পরে আর তেমন শক্তিধর ছিল না ঠিকই কিন্তু পূর্ববঙ্গের প্রতিটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে- ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠন, দেশ থেকে লীগ সরকারের উচ্ছেদ, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এমন প্রতিটি ক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিয়ামকের ভূমিকায়। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও তারা ঘর ও বাইরে থেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। কমিউনিস্ট পার্টি অনুপ্রাণিত না করলে মুক্তিযোদ্ধারা শক্তিশালী পাক সেনার সঙ্গে অমন তীব্র লড়াই গড়ে তুলতে পারত কিনা সন্দেহ। 

এই দীর্ঘ ইতিহাস কম বেশি বিমলবাবুর বইতে আছে। কখনো তিনি লিখেছেন আত্মকথনের ভঙ্গিতে, কখনো ভাষ্যকারের। তিনি নিজে চীনপন্থিদের সঙ্গে যুক্ত হন এবং তিনি জানিয়েছেন-
চীনপন্থিরা মোটা দাগে চারটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। পরে তা আরও বহুধা বিভক্ত হয়েছে। সুখেন্দু দস্তিদার, তোয়াহা ও হকের তৈরি প্রথম চীনপন্থি দলটির নাম ছিল ইপিসিপি (এম. এল) আর একটি ধারার প্রতিনিধিত্ব করতেন কমরেড দেবেন, কমরেড বাশার, কমরেড মতিন ও কমরেড আলাউদ্দিন। অপর ধারায় ছিলেন নুরুল হুদা মির্জা, আনোয়ার জাহিদ প্রমুখ। ’৬৭ সালের পর পার্টি আবার ভাঙে দু’বার ’৬৮ ও ’৬৯ সালে।

বিমলবাবুর বইতে আছে, ’৯২ সালের ৪ মে কমরেড রাশেদ খান মেনন ও কমরেড রণোদের বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে কমরেড অমল সেন ও কমরেড বিমল বিশ্বাসের নেতৃত্বে পরিচালিত ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ ও কমরেড খন্দকার আলী আব্বাসের সাম্যবাদী দল যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (পৃ. ৯৭)। এই ওয়ার্কার্স পার্টিতেও পরে আবার ভাঙন ধরে।

আসলে পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এর মধ্যে বরাবরই দুটি ধারা অতি প্রকট। এর একটি হলো আত্মত্যাগ ও অপরিমেয় কষ্ট স্বীকারের ধারা। এর শুরু সম্ভবত ’৫০ সালের খাপড়া ওয়ার্ড থেকে। মুক্তিযুদ্ধে ঘটেছে আরও অনেক ছোট বড় খাপড়া ওয়ার্ড। অতীতের পার্টিতে এমন কোনো নেতা বা কর্মী নেই যিনি দীর্ঘ সময় আত্মগোপনে কাটাননি অথবা যার কম-বেশি কারাবাসের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নেই। বিমলবাবু বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে দেখিয়েছেন রক্ষীবাহিনীর হেফাজতে তার জীবন রক্ষা হয়েছে স্রেফ নিয়তির জোরে। রক্ষীবাহিনীর সীমাহীন নির্যাতন তার মেরুদণ্ডে সৃষ্টি করেছে স্থায়ী বড় ধরনের ক্ষতের। এছাড়া দ্বিতীয় যে ধারাটি তা হলো, ধারাবাহিক, যুক্তিহীন ভাঙনের। এমন উপর্যুপরি ভাঙন আর কোনো দেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে ঘটেছে কিনা সন্দেহ। বস্তুত এর জন্য দায়ী নেতাদের অসহিষ্ণুতা, দলাদলি এবং সর্বোপরি মার্কসবাদী জ্ঞানের অপরিপক্বতা। লক্ষ করার মতো, মস্কোপন্থিরা চীন সমর্থকদের ভাষায় সংশোধনবাদী হলেও তাদের দলে ভাঙনের নজির তুলনায় কম। 

বিমলবাবুর রচনার সাফল্য এই যে, এতে ওই দুই ধারাই সবিস্তারে বিবৃত হয়েছে। দ্বিতীয় সাফল্য, অমল সেনসহ সেই আমলের কিছু প্রবীণ কমরেড সম্পর্কে তিনি যেমন শ্রদ্ধাবনত তেমনি তিনি যাদের মতের বিরুদ্ধে মনে করেন, বিবেচনা করেন সংশোধনবাদী বলে- তাদের আক্রমণ করতে ছাড়েননি। কিন্তু ভালো লাগার বিষয় হলো সেই আক্রমণ সর্বদাই সংযত ও রাজনৈতিক। বইটিতে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ আছে যা না হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। তাছাড়া এই সমালোচকের মতে, দ্বিতীয়  ত্রুটি- সকল নেতা ও কর্মীর নামের আগে কমরেড শব্দটি ব্যবহার করা। যেমন কমরেড অমল সেন, কমরেড আব্দুল মতিন, কমরেড আলাউদ্দিন ও আরও অনেক। রাজনীতির ময়দানে হয়তো তারা ছিলেন বিমলবাবুর কমরেড কিন্তু যখন তিনি এক ইতিহাস রচনাকার তখন তার বিপরীতে এই মানুষগুলো আর কমরেড থাকবেন কেন? তাহলে তার নির্মোহ প্রাবন্ধিকের দাবি আর ধোপে টেকে না।

লেখকের গদ্যটি ছিমছাম, অলঙ্কার বর্জিত কিন্তু এই ধরনের ইতিহাস রচনার জন্য যথাযথ। এই বই পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট রাজনীতির এক রোমহর্ষক, জোয়ার ভাটায় সম্পৃক্ত ও চমৎকার বিশ্লেষণী ইতিহাস, যা নিশ্চিতভাবেই পাঠককে মুগ্ধ করবে। আর আগ্রহ তৈরি হবে এই লেখকের পরবর্তী রচনাটি পড়ার জন্য। 

যা দেখেছি যা করেছি
(প্রথম খণ্ড) 
বিমল বিশ্বাস
জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ
বেসমেন্ট, ৫৫ কনকর্ড 
এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্স, 
কাঁটাবন, ঢাকা। 
মূল্য-৬৫০ টাকা মাত্র

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //