নীল সার্কাসের ঘোড়া: এক মৃদু ও আত্মধ্বংসী মানুষের দুনিয়া

অঙ্কে শূন্য পেলে কী হয়? শূন্য তো কতজনই পায়—নানা ধাঁচের পরীক্ষায়। কিন্তু যদি সে পরীক্ষাটি হয় গোটা জীবনকে উদ্দিষ্ট করে, তবে? তবে তো ‘অঙ্কে শূন্য পাওয়া ভীষণ ব্যথার’–ই বটে। তবুও কতজন কতভাবে শিখে নেয় শূন্যের নামতা। কতজন শিখে নেয় ব্যথার নিদান। কিন্তু শূন্যের ব্যথা ভোলাতে কেউ যদি কারও শূন্যের ভেতর অর্জুনের চারা বুনে দিতে চায়, তবে তাকে কী বলা যাবে? নাহ, সে কথা না ভেবে বরং শূন্য নিয়ে মেতে থাকাই ভালো। এই সব বলাটলা পাশ কাটিয়ে বরং একটু সানাই শোনা যাক, যা ছুটে আসে শ্মশানঘাট পেরিয়ে, সঞ্চিত জলের সাথে মানুষের জমানো ক্লেদের ভেতর থেকে, এক প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাসের মতো। এই সুরময় দীর্ঘশ্বাসের খনি বলেই কি তবে চরিত্রটির অবধারিতভাবে নাম হয়—সুরো, যে বেসুরো এই দুনিয়ার জন্য এক ঋজু কটাক্ষই বলা যায়। যে কিনা ‘পাখিদের পাতপেড়ে খেতে দেয় বহুরূপী ধান’, যে কিনা ‘এ দুধ এখন আমি কাকে গেলাই বলো’ বলে ছড়িয়ে দেওয়া দীর্ঘশ্বাসের ওপর নিজেই বোলায় আদুরে আঙুল। ‘পরিস্থিতি বুঝে আমরা আসলে সবাই সবার মা’ উচ্চারণে জানিয়ে দেয় নিদানের ঠিকুজি।

এ যাত্রায় আছে মোহরও, যে কিনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে রেওয়াজ করে ‘শামুকের সুর’। এ এক দারুণ যাত্রালিপি, যেখানে ‘পথ হারানোর শোকে কান্না পেলে হুট করে সূর্য ডুবে যায়’। আর সেই সূর্যের সেই ডুব অবধারিতভাবেই নামায় এক গাঢ় অন্ধকার, যা ভীতিকর–সংশয় সম্ভাবী। সেই অন্ধকারের কোটর থেকে বাঁচার জন্যও প্রস্তাব হাজির। সেখানেও আছে এক দারুণ নিদান।

এ গাথার ভেতর, আনাচে–কানাচে লুকিয়ে থাকে খলনায়কও। কখনো চান্দুদা, কখনো করোনা, কখনো অনামা কেউ হয়ে সে লুট করে যায় আদুরে রোদের ঝাঁপি। সুরতরঙ্গ গাথায় তুলে দিয়ে যায় এক বিকট চিৎকারের হল্লা। কিন্তু ভীষণ নীরব, ভীষণ একান্ত বিলাপের মতো, ভীষণ কান্নাময়। সুজন সুপান্থ, যে কিনা কবি, এবং কবিই, তিনি এইসব আপাত নিরীহ কিন্তু প্রশ্নসম্ভাবী এবং অতি অবশ্যই আহাজারিময় গদ্যে ভারী করে তোলেন আমাদের শ্বাস, যা সশব্দে নয়, সুকৌশল চোরাপথেই ছাড়াটা দস্তুর। একের পর বর্ণিল পুঁতি বসিয়ে যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর ছুড়ে দেওয়া কিছু প্রশ্ন মূলত পুরুষকে, পুরুষ ভাবকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। ফলে মীন–মকরের ঘর থেকে বেরিয়ে শুধু একটি প্রশ্নই ঘোরে অপ্রতিহত—‘চান্দুদার আদরে এত ব্যথা হয় কেন?’

কাব্যগন্ধী এই গদ্যমালার কোথাও সুজন সুপান্থের কোনো সোচ্চার কণ্ঠ নেই। সব যেন মেনে নেওয়া। সব ক্ষয়, সব লুট ও লুটেরাকে মৃদু প্রশ্নে মেনে নিতে থাকে চরিত্ররা। তাদের তরফ থেকে কোনো প্রবল প্রতিরোধ নেই। এ যেন এই রাষ্ট্র বা সমাজের অগণিত নাম হারিয়ে ফেলা মানুষের নীরব পদযাত্রা। সুজন সুপান্থের এই কাব্যগন্ধী গদ্য শেষতক মৃদু ও আত্মধ্বংসী, ক্ষুব্ধ অথচ আহাজারিসর্বস্ব, প্রেমময় এবং প্রতারিত এক মানুষের দুনিয়া ঘুরিয়ে আনে আমাদের, যার ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেওয়া থাকে কবিসুলভ দারুণ সব চিত্রকল্প। এক দিশাহীন দেশের এই ভ্রমণ ক্লান্ত করে না; নিবিষ্ট করে নিজের ভেতর।

এক বিপুল বিস্তারী বয়ঃসন্ধির ভেতর ঢুকে পড়া পাঠকের পক্ষে ঠাওর করা সম্ভব হয় না, সে ফুল কুড়াবে, নাকি মৃত প্রজাপতির ডানা। ফলত সে হারিয়ে যায়। মেলায় নয়, সার্কাসে, যে সার্কাস অথবা সেখানে ঘুরে বেড়ানো ঘোড়াটি নীল। এ নীল বেদনার, নাকি বিস্তারের? নাকি দুটোই? সে প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সুজন সুপান্থের ‘নীল সার্কাসের ঘোড়া’র সাথে ঘুরে আসা যেতে পারে। একমাত্র ভ্রমণই পারে প্রশ্নের মীমাংসা দিতে।

নীল সার্কা‌সের ঘোড়া

মুক্তগদ্যের বই

লেখক: সুজন সুপান্থ

প্রচ্ছদ: মাহফুজ রহমান

প্রকাশক: স্বপ্ন'৭১ প্রকাশন

বই‌মেলায় স্টল নম্বর: ১৯০

দাম: ১৫০

বইমেলা ছাড়াও কারওয়ান বাজারে প্রথমার আউট‌লে‌টে সরাসরি এবং রকমারি ডটকমে অর্ডার করেও বইটি সংগ্রহ করা যাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //