শিশুর ছড়াপাঠের অভ্যস্ততা

লামিয়া রূপকথা। বইমেলায় এসেছে মা-বাবার সঙ্গে। দেখা হলো শিশুচত্বরে। বয়স ছয়-সাত হবে। বাবা-মায়ের ফাঁক গলে নিজেই বইয়ের পৃষ্ঠা একটা একটা করে উল্টিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ দেখল। রেখে দিয়ে হাতে তুলে নিল লাল রঙের একটি বই। লেখক লুৎফর রহমান রিটন। বইয়ের নাম ছোটদের ছোট ছোট ছড়া। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বাবা-মাকে বলল, এটা নেব। লামিয়া আরও কিছু ছড়ার বই কিনল। বললাম, ছড়া পড়তে ভালো লাগে তোমার? বলে- হ্যাঁ। আমার অনেক ছড়া মুখস্থ। কেন ভালো লাগে বলতেই লামিয়ার মা বলতে শুরু করলেন, সেই এত্তটুকুন বয়স থেকেই ওকে ছড়া শোনাই। শুনে শুনে অনেক ছড়াই মুখস্থ। তবে সেসব ছড়ার বেশির ভাগই লোকছড়া। নতুন ছড়া পড়াব বলেই মেলায় এসেছি। লামিয়া মোটাসোটা বইটি হাতে নিয়ে একটা একটা করে পৃষ্ঠা উল্টাছে আনন্দ নিয়ে।

শিশুরা এমনই। মন সারাক্ষণ থাকে চনমন। গঙ্গাফড়িঙের মতো। বল্গা হরিণের মতো। লাটিম ঘোরার মতো ঘুরতে থাকে কিন্তু ঝিমিয়ে পড়ে না। নিয়ম মানে না। শুধু আনন্দ দেয়। হাসায়। বিশেষ কোনো অর্থ খোঁজে না। শিশুমনে গভীরভাবে সুরের ঝঙ্কার তোলে। কল্পনা করতে শেখায়। অসম্ভবকে সম্ভব করার প্ররোচনা দেয়। কাল্পনিক বিষয়-আশয় তার মনকে নাড়াতে থাকে। রূপকথার রাজা বানিয়ে দেয়। যত দেখে আশপাশ, ঘাস-লতাপাতা-ফুল, কুল কুল শব্দে বয়ে চলা নদীজলে ঢেউ, তাতে শিশুমন হয়ে ওঠে ব্যাকুল। শিশুর এই ব্যাকুলতা, ছোট্ট মনের ধারণক্ষমতা বুঝেছেন অনেকেই। তার খেই হারিয়ে ফেলেননি। শিশুর মনোবিকাশ নিয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন পাঠোপযোগী রচনা। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অন্যতম। সুকুমার রায় তো আবোল-তাবোল লিখে শিশুর মানসিক বিকাশ সাধনে অনন্য হয়ে রয়েছেন।

ভূমিষ্ঠের পর শিশু প্রথম মায়ের গন্ধ পেয়ে চিনতে শুরু করে। প্রথম বুলিও মায়ের কাছ থেকেই শেখে। কোনো শব্দ শুনলে সাড়া দেয়। প্রভাবিত হয়। শ্রুতি শিশুমনে প্রভাব ফেলে। কোনো শব্দের অর্থ হয়তো বোঝে না কিন্তু শব্দের ভেতরকার সুর, ছন্দ তাকে আন্দোলিত করে তোলে। সে শুনতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। মায়েরাও এই কৌশলটা শিশুর ওপর চেতনে অথবা অবচেতনে শিশুর ওপর প্রয়োগ করে। তাকে ঘুমপাড়াতে, খাওয়াতে, গোসল থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে ছড়ায় ছড়ায়, সুরে সুরে কথা বলতে থাকে। মা হয়ে ওঠেন শিশুর প্রথম শিক্ষক। ছড়ার প্রতি মুগ্ধতাও গড়ে ওঠে মায়ের কাছ থেকেই। এমন কোনো মা-বাবা নেই, তার সন্তানকে ঘুমপাড়াতে ছড়া আওড়াননি কিংবা আজও আওড়ান না। 

লোকসাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গও এই ছড়া। এটি শুধু ভূণ্ড ভারতে নয়, বিশ্বজুড়েই বিরাজমান। প্রত্যেক শিশুই তার শৈশবে একইভাবে সোনার কাঠির মতো ছড়ার পরশ পেয়ে থাকে। কারণ যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর শিশুর মনোযোগ কাড়তে ছড়ার এক সম্মোহনী শক্তি রয়েছে। ছড়ার শব্দও হয় সহজ-সরল। ছন্দ থাকে। অন্ত্যমিল থাকে। সুর করে পড়া যায়। এককথায় শিশুর চিন্তার জগৎকে, কল্পনাশক্তিকে, সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে ছড়া সোনার কাঠির মতোই পরশ দিয়ে যায়। শিশুরা ক্রমে শিখতে থাকে। যত শেখে, যত শোনে, তত পড়ে। যত পড়ে, তত মুগ্ধ হয়। রূপকথার রাজ্য থেকে ঘুরে নিয়ে আসে এই ছড়া। বীরপুরুষ হতে শেখায়। শুধু তা-ই নয়, ক্রমে সে পারিপার্শ্বিক সবকিছু দেখতে দেখতে একসময় রপ্ত করে নেয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //