বাজেট কি সুদৃঢ় আগামীর পথ দেখাবে?

জাতীয় সংসদে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটা করোনা মহামারির মধ্যে দ্বিতীয় বাজেট প্রস্তাব৷ এ বাজেটে বাড়েনি ব্যক্তির করমুক্ত আয় সীমা৷ তবে কমানো হয়েছে কর্পোরেট কর৷ আবার নারীদের ক্ষুদ্র ব্যবসায় করমুক্তির সীমা বেড়েছে ৪০ ভাগ৷

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি৷ এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয়ের আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি বেশি৷ আসছে অর্থবছরে সরকারের মোট ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি প্রায় ৩ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকাই খরচ হবে সরকারের পরিচালন ব্যয়ে৷ প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ যাবে সুদ মেটাতে যার আকার ৭০ হাজার কোটি টাকা৷ এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের বিপরীতে সুদ দিতে হবে ৬২ হাজার কোটি, আর বৈদেশিক ঋণের সুদ মেটাতে যাবে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা৷ 

বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ 

খাতভিত্তিক ব্যয়ে হিসাবে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে জনপ্রশাসন৷ ৬৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকাই যাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে৷ ১৫ দশমিক সাত শতাংশ অর্থ খরচ হবে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে৷ পরিবহণ ও যোগাযোগে ব্যয় হবে প্রায় ১২ শতাংশ৷ এছাড়া স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে সাত শতাংশ। প্রতিরক্ষায় ছয় দশমিক দুই শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে পাঁচ দশমিক সাত শতাংশ। স্বাস্থ্যে পাঁচ দশমিক চার শতাংশ। কৃষিতে পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হবে৷

টাকা আসবে যেখান থেকে

বৈদেশিক অনুদান মিলিয়ে বাজেটে আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার৷ সে হিসেবে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার টাকার বাজেটে ঘাটতি প্রায় এক তৃতীয়াংশ৷ রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা৷ এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের জন্য তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে৷ তাদের সবচেয়ে বেশি ৩৮ দশমিক সাত শতাংশই মূল্য সংযোজন কর থেকে আদায় করতে হবে৷ আয়কর থেকে আসবে ৩১ দশমিক আট শতাংশ৷ বাকিটা আসবে আমদানি, সম্পূরক শুল্ক ও অন্যান্য কর থেকে৷ 

অনুদান ছাড়া সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার৷ এর যোগান হিসেবে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বৈদিশিক ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে৷ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার৷

সামাজিক খাতে ব্যয়

২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৭ দশমিক আট-তিন শতাংশ৷ বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিলো ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা৷ আগামী অর্থবছরের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ১২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে৷ এছাড়া আর কোনো ভাতা বাড়ানোর ঘোষণা নেই৷ তবে বাড়বে উপকারভোগীর সংখ্যা৷ সোয়া লাখ বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত নারী নতুন করে ভাতার আওতাভুক্ত হবেন৷ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকার ২৫ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে৷ গত বছর বরাদ্দ ছিলো ২৫ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা৷ 

কভিড ১৯ মোকাবেলায় জরুরি চাহিদা মেটাতে গত বছরের মতো এবারো ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ 

নতুন অর্থবছরের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ৩৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা৷ যা বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে প্রায় চার হাজার কোটি বেশি৷ এছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় বেড়েছে এক হাজার কোটিরও কম৷ 

বেড়েছে নারী উদ্যোক্তাদের করমুক্ত আয়

বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৪০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে৷ আগে তাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ছিলো ৫০ লাখ৷ এখন তা আরো ২০ লাখ বাড়ানো হয়েছে৷ অর্থাৎ নারী উদ্যোক্তারা বছরে ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করলে তার জন্য আয়কর দিতে হবে না৷

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য করছাড় 

ব্যবসায়ীদের জন্য কর্পোরেট করহারে ছাড় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী৷ শেয়াবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির জন্য এই হার সাড়ে ৩২ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে৷ তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ দশমিক ৫ শতাংশে করা হয়েছে৷ এক ব্যক্তি কোম্পানির জন্য তালিকাভুক্ত ছাড়াদের জন্য করহার ৩২ দশমিক পাঁচ শতাংশ৷ ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতার জন্য বিদ্যমান করহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ তবে তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে৷

যদি কোন প্রতিষ্ঠান মোট কর্মচারী ১০ শতাংশ বা ১০০ জনের বেশি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয় তবে কর্মচারিদের পরিশোধিত বেতনের ৬৫ শতাংশ বা প্রদেয় করে পাঁচ শতাংশ কর রেয়াত দেয়া হবে৷

বাজটের মূল্যস্ফীতি ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি

প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। বাজেটের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে মোট জিডিপির আকার ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।

বাজেট ঘাটতি যেভাবে মোকাবেলা হবে

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মোট ঘাটতি ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মোকাবেলায় বৈদেশিক অর্থায়ন থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। আভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে নেয়া হবে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ সহায়তা থেকে ৮৮ হাজার ২৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নতুন এডিপির এই আকার চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং সংশোধিত এডিপির তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ছিলো ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা এবং সংশোধিত এডিপির আকার হচ্ছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা।

মেইড ইন বাংলাদেশ

অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশে মেগা শিল্পের বিকাশ ও মেইড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় সরকার বদ্ধ পরিকর৷ এজন্য অটোমোবাইল থ্রি-হুইলার ও ফোর হুইলার উৎপাদনকারীদের জন্য এবার বিশেষ সুবিধা রেখেছেন তিনি৷ শর্ত সাপেক্ষে দশ বছর মেয়াদী কর অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তাব করেন তিনি৷ আরো কিছু শর্ত সাপেক্ষে পরবর্তীতে আরো দশ বছর তা বাড়ানোর সুযোগ থাকছে৷ এছাড়াও হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের পণ্যের উৎপাদকারী কোম্পানিকেও শর্ত সাপেক্ষে দশবছর মেয়াদি কর অব্যহাতি সুবিধা দেয়া হবে৷ 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //