নজিরবিহীন জনদুর্ভোগেও গতানুগতিক বাজেট

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে নজিরবিহীন সংকটে পড়েছে দেশ। জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে। দুই দশক পর প্রথমবারের মতো দরিদ্রতার হার বেড়েছে। প্রবৃদ্ধির গতি নিম্নমুখী। একদিকে মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, সঠিকভাবে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে কাজ হারিয়ে খাবার জোটাতে হিমশিম খাচ্ছেন বিপুলসংখ্যক কর্মজীবী মানুষ।

নজিরবিহীন এই সংকট কাটাতে নতুন বাজেটে নতুন কিছু আনা হবে এমন প্রত্যাশা ছিল; কিন্তু বাজেটে তেমন কিছুই রাখা হয়নি, আগের মতোই গতানুগতিক ধারার বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। করোনার কারণে সৃষ্ট প্রায় সাড়ে ৩ কোটি নতুন গরিব মানুষদের বরাদ্দ দূরের কথা তাদের বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা  এবং কৃষি খাতের দুর্বলতা দূর করে শক্তিশালী করার মতো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এবং বাড়তি বরাদ্দও দেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিশ্চিত পরিস্থিতির বাস্তবচিত্রের প্রতিফলন বাজেটে ঘটেনি এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় নীতিগত কৌশল ও বরাদ্দের বিষয়ে উদাসীনতা রয়েছে। 

আগামী এক বছরে রাষ্ট্রের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব জাতীয় সংসদে গত ৩ জুন উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। খরচের হিসাবে দেশের ইতিহাসে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত ৫০তম বাজেটটি সবচেয়ে বড়।

জাতীয় সংসদে আগামী এক বছরের বাজেট পেশ করা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। স্বাধীনতার পর কোনো বছরই এই প্রক্রিয়ায় ছেদ পড়েনি। করোনাভাইরাসের তীব্র সংক্রমণের মধ্যেও চলতি অর্থবছরের বাজেট দেওয়া হয়। করোনাভাইরাসের মহামারি ছোবল এখন তীব্রতর হচ্ছে। আরেকটি নতুন বাজেট দেওয়া হলো। গতানুগতিক প্রক্রিয়ার বাজেট দেওয়া হলেও, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক নেই কিন্তু; জনজীবন স্বাভাবিক নয়। সরকারি খাতে নিয়োজিত কর্মীরা ছাড়া আর কেউই আয়-রোজগার নিয়ে নিশ্চিন্ত নন। 

সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, করোনার কারণে সৃষ্ট দেড় থেকে দুই কোটি নতুন গরিবকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাদের জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। করোনায় নতুন গরিবের সংখ্যা বাড়ল কত, তা নিয়ে বাজেটে কোনো তথ্য নেই। এ নিয়ে সরকারি কোনো পরিসংখ্যানও নেই। তাই নতুন গরিবদের জন্য কোনো নীতিও নেই। 

রাজধানীর অনেকেই ফিরেছেন গ্রামের বাড়িতে। প্রবাসীদের অনেকেই দেশে ফিরে আর যেতে পারছেন না। নিত্যদিনের খরচ মেটাতে সঞ্চয় ভেঙেছেন, সম্পদ বিক্রি করেছেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের খাবার জোটাতে তাদের শঙ্কা প্রতীকী অর্থে সুকান্ত পালের কবিতার মতোই এক মুঠো পান্তা ভাতে, এক চিমটি নুন,/আর হালকা করে সরষের তেলের সহিত বহু স্বাদের একটা কাঁচা লঙ্কা;/কিংবা এক টুকরো ঝাঁঝালো পেঁয়াজের গন্ধে ওরা তো বেশি খুশি!/কিন্তু যখন নুন আনতে ফুরায় তখন ওদের চোখেও দেশি আশঙ্কা!

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনা সংক্রমণে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে অনেক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের কাতারে নেমে এসেছেন। অনেক মানুষের আয় কমেছে। অন্য দিকে আমরা দেখছি, সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। অথচ সরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয় এসএমই খাতে; কিন্তু সরকারের প্রণোদনা পেলেন মূলত বড় শিল্প মালিকরা। এ ছাড়া প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে মূলত ব্যাংকের মাধ্যমে; কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকেরই ব্যাংক হিসাব নেই। সে জন্য এনজিওগুলোর মাধ্যমে তাদের ঋণ দেওয়া উচিত। 

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকহারে ছেদ পড়ায় ইতিমধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। সুপ্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বেতন কমানো, সুযোগ-সুবিধাবন্ধসহ খরচ কমানোর নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক এটিও সবার অজানা। করোনাভাইরাসের ছোবলে গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছেন। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন-জীবিকায় আঘাত হেনেছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসেবে ভাইরাসের সংক্রমণে আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯ সালের তথ্যমতে, দেশে দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার মধ্যে সাড়ে ৩ কোটির মতো মানুষ গরিব।বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপের তথ্য মতে, করোনার কারণে নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ গরিব হয়েছেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাবে নতুন করে গরিব হয়েছে ১ কোটি ৬৮ লাখ মানুষ। সানেমের হিসাবে নতুন-পুরাতন মিলে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর এখন ৪২ শতাংশ গরীব। নতুন-পুরনো মিলে গরিব মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি থেকে ৬ কোটি। বেসরকারি স্কুল, কলেজ, কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারী, পর্যটনসংশ্লিষ্ট কর্মী, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মী, পরিবহন খাতের কর্মী, সুপারশপ ও শপিংমলের কর্মী- এদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বেশিরভাগই কর্মস্থল ছেড়ে গিয়ে গ্রামে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এর বাইরে বেসরকারি বহু কারখানা ও প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, বিনা বেতনে ছুটিতে আছেন। আবার অনেকে আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি করছেন। এদের জন্য তেমন কিছু রাখা হয়নি বাজেটে। 

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশে জীবন ও জীবিকার বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন ঘটেনি। প্রস্তাবিত বাজেটের শিরোনামে জীবন ও জীবিকার কথা বলা থাকলেও, বাস্তবতার সঙ্গে এর সংযোগ নেই। বর্তমান জীবন ও জীবিকার বাস্তবতার সঠিক কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। আমরা যদি সমস্যাকে সঠিকভাবে তুলে আনতে না পারি, তবে এর সমাধান করব কীভাবে। সমস্যা যদি সঠিকভাবে না পাই, এর সমাধান সঠিক হবে না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার ইতিমধ্যে ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। স্বল্প সুদে ঋণ হিসেবে এই অর্থের সিংহভাগই পেয়েছেন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতিরা। কৃষক পর্যায়ে সামান্য অর্থ বিতরণ করা হলেও, সারাদেশের কাজ হারানো প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা, অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার কোনো সহায়তা পাননি। 

নতুন প্রস্তাবিত বাজেটেও ব্যবসা-বাণিজ্যকে চাঙা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে কোনো খাতে করারোপ করা হয়নি। বরং অনেক খাতেই করহার কমানো হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য শুল্ক-কর ছাড় সুবিধা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করা। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। সমাজের অসহায় মানুষদের সহায়তার জন্য বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে প্রতি বছরই বরাদ্দ থাকে। এ বছরও বরাদ্দ রাখা এবং তা বাড়ানো হয়েছে। এই বরাদ্দ সমাজের একেবারে অসহায় শ্রেণি যেমন বয়স্ক, বিধবা। এর বাইরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবৃত্তি এসব খাতগুলোতেই বেশি খরচ করা হয়।

চলতি বছরের মোট বরাদ্দ ছিল ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা খরচ করেও এখনো এই শ্রেণির ৪৬ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাইরে রয়েছে। বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা হলেও তাদের শতভাগ কর্মসূচির আওতায় আনা যাবে না। তাহলে নতুন গরিব মানুষদের এই খাত থেকে অর্থ পাওয়ার কোনো সুযোগই থাকছে না। কিন্তু করোনার কারণে সৃষ্টি দরিদ্র মানুষের জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। তাদের হাতে অর্থ পৌঁছে দেওয়া, কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করা এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। 

উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, করোনাভাইরাস অতিমারীর দ্বিতীয় ধাক্কা চলাকালে এই বাজেট দেওয়া হয়েছে। প্রথম ধাক্কায় অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব বিপর্যয় নেমে আসে। মানুষের জীবন ও জীবিকা বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ১৯৯০ দশকের পর এ বছর প্রথম নতুন করে দরিদ্রতার হার বেড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সবার জন্য বরাদ্দ না থাকায় নিম্নআয়, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও নারী-শিশুদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে; কিন্তু বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ আসেনি।

গতানুগতিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় নতুন বাজেটটি গতানুগতিক ধারার বাইরে যেতে পারেনি। করোনাভাইরাসের ক্ষতির চিহ্নিতকরণ এবং ক্ষতি মোকাবেলায় কোনো ধরনের নীতি-কৌশলের কথা বাজেটে স্থান পায়নি।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //