অনুদান নয়, বিনিয়োগ চায় সংস্কৃতিকর্মীরা

বাজেটে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি

অনুদানের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সংস্কৃতি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন দেশের খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণে মানুষের চিন্তায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে দেশব্যাপী  সাংস্কৃতিক জাগরণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

সংস্কৃতিজনদের দাবি মূল বাজেটের অন্তত ১ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হোক সংস্কৃতি খাতে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষণসহ সংস্কৃতিচর্চায় বিরাজিত সংকট ও সমস্যা মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সংস্কৃতি, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় এই গুরুত্ব ও যৌক্তিকতা অনুভব করে যথাযথ ব্যবস্থা ও উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা। 

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, সংস্কৃতি খাতকে গুরুত্ব না দিয়ে আমরা যে মানবিক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখি, সেটা সম্ভব না। প্রতিবারই সংস্কৃতি খাতের বাজেট আমাদের হতাশ করে। আমরা আশা করেছিলাম, মূল বাজেটের অন্তত ১ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হবে সংস্কৃতি খাতে। সেটা বিগত এক দশক ধরে দাবি জানিয়ে আসছি, কিন্তু সেটা করা হয়নি। এটা ভীষণ মর্মাহত হওয়ার মতো। রাষ্ট্রের পরিচয় যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে সংস্কৃতির উপর, সেখানে অবহেলা দুঃখজনক। প্রতিবারই সংস্কৃতি খাতে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ সারাবছরই সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে হবে বলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বক্তৃতায় বলেন। এখন বাজেটে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেটা কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়। সমাজের সুস্থ চর্চা অব্যাহত রাখতে হলে সংস্কৃতি খাতে অবশ্যই বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। 

সংস্কৃতি খাতে বিনিয়োগ করতে হবে উল্লেখ করে রামেন্দু মজুমদার বলেন, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণে মানুষের চিন্তায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক জাগরণ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ অপরিহার্য। নামেমাত্র অনুদান দিয়ে সর্বগ্রাসী সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করা যাবে না। বাজেটে সংস্কৃতি বরাবরই উপেক্ষিত হয়। সংস্কৃতির সবকিছুকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও তা শুধু মুখে মুখেই থেকে যায়। বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিই হচ্ছে সংস্কৃতি।

সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সরকারের যে অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি, তা বাজেট বরাদ্দের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যাবে। ফলে সংস্কৃতি কর্মীদের হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। অথচ মানুষের চিন্তায় ও মননে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ, এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন। নামমাত্র অনুদান দিয়ে সর্বগ্রাসী সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করা যাবে না।

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা সংস্কৃতি খাতকে কেমন অবহেলার চোখে দেখে, তারই প্রতিফলন ঘটে বাজেটের মধ্য দিয়ে। 

আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্তারা মুখে বলেন, সংস্কৃতির কথা; কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখি না। সংস্কৃতিবান্ধব সরকার বলে যাচ্ছি, কিন্তু রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সংস্কৃতিকে অবহেলা আমাদের মর্মাহত করে। সংস্কৃতি খাতকে অবহেলা করে মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব না। সংস্কৃতিচর্চাকে অবহেলা করে এই ইট-পাথরের উন্নয়ন কোনোভাবেই টেকসই কিছু হবে না। সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। প্রতিবছরই বাজেট ঘোষণার পর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা প্রতিক্রিয়া জানালেও এবার আগে থেকে বাজেট বৃদ্ধির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে সেই দাবি তুলে ধরেছেন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েও দাবিগুলো জানিয়েছেন।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেই সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ বলে গলা ফাটাই। অথচ বাস্তবে সংস্কৃতিচর্চাকে লালনের জন্য কোনো পৃষ্ঠপোষকতা করি না। আমাদের দাবি ছিল মূল বাজেটের অন্তত এক শতাংশ সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হোক। বিগত কয়েক বছরে সেটা তো দেওয়া হয়নি, বরং কমানো হয়েছে। এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশা করি না। সরকারের কাছে আমাদের দাবি সংস্কৃতি খাতে মূল বাজেটের এক শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হোক।

জোটের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) আহ্কামউল্লাহ বলেন, সংস্কৃতিকে জাতির মনন বিকাশের সোপান বিবেচনা করে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১ শতাংশ সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ করতে হবে। এই বরাদ্দের এক বড় অংশ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, সংগঠনের অনুদান, শিল্পী সম্মানী এবং বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে। প্রতিটি উপজেলায় ৫০০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন নির্মাণ এবং উপজেলা সদরে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া অসচ্ছল শিল্পীদের মাসিক অনুদানের পরিমাণ বাস্তবতার নিরিখে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা এবং এ ক্ষেত্রে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাই।

সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোসহ বেশ কিছু প্রস্তাবনা সরকারের কাছে তুলে ধরেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে এক শতাংশ সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ দাবির পাশাপাশি প্রত্যেক উপজেলায় ৫০০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন নির্মাণ, উপজেলা সদরে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ নির্মাণ, একটি বিশেষ প্রকল্প নিয়ে প্রতিবছর অন্তত ১০০টি উপজেলায় এ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে দেশের সব কয়টি উপজেলায় সংস্কৃতি চর্চার নেটওয়ার্ক তৈরি হবে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ স্মরণে রেখে প্রত্যেক জেলায় ‘বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ স্মৃতিভবন’ নির্মাণ করা। এ ভবনে ৭০০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন, মহড়া ও কর্মশালার কক্ষ, সেমিনার হল, পাঠাগার, ক্যান্টিন ও ৫ থেকে ১০ জন থাকার মতো কক্ষের ব্যবস্থা করা, যত দ্রুত সম্ভব এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।

শিক্ষাকার্যক্রমে সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিবছর সাংস্কৃতিক উৎসব ও প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা রাজধানীসহ প্রত্যেক জেলায় সরকারি উদ্যোগে একটি করে স্থায়ী যাত্রাপালার প্যান্ডেল নির্মাণ করা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //