পণ্যের দাম এত বাড়ছে কেন

সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, কৃষিপণ্যের উৎপাদন প্রতিবছরই বাড়ছে। এমনকি কিছু খাদ্যপণ্য উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি। তেমনই দুটি ফসল আলু ও পেঁয়াজ। এরপরও দেশের বাজারে খাদ্যপণ্য দুটির দাম সম্প্রতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। একইভাবে নিয়ন্ত্রণ নেই নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের বাজারও।

এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বরাবরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটকে দায়ী করছেন। কৃষি অর্থনীতিবিদরা যদিও বলছেন, যুদ্ধের অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে মূলত একটি পক্ষ বছরজুড়েই দেশের খাদ্যপণ্যের বাজারকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় গত বছরের প্রথম দিকে। দেশ দুটি খাদ্যপণ্যের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক হওয়ায় এর প্রভাব পড়তে শুরু করে পুরো বিশ্বেই। হু-হু করে বাড়তে শুরু করে খাদ্যপণ্যের দাম। তবে গত কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী। দেশের বাজারে যদিও এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।

দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের দাম বাড়ে ৯৩ শতাংশ, আলু ৭৩ শতাংশ, আদা ২১২ শতাংশ, চিনি ৬৪ শতাংশ। কৃষি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, যুদ্ধের দোহাই দিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে। সরকারি মনিটরিং না থাকায় রাতারাতি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। 

দেশে চালের জোগানের সিংহভাগই আসে বোরো ও আমন মৌসুম থেকে। আর অল্প জোগান আসে আউশ মৌসুমে। এ বছর বোরো ও আমন দুই মৌসুমেই গত বছরের চেয়ে ফলন হয়েছে অনেক বেশি। তবুও গত বছরের শেষ দিকে প্রায় ৫-৬ শতাংশ দাম বাড়ে প্রধান এ খাদ্যশস্যটির। বোরো মৌসুমে অবশ্য চালের বাজার আগের দামেই ফিরে আসে। কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত অর্থবছরের চেয়ে এবার প্রায় ২৫-৩০ লাখ টন বেশি চাল উৎপাদন হবে। 

দেশের বাজারে সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেঁয়াজ ও আলুর দাম। দুটি পণ্যই চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদন হয়েছে। ডিএইর হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ টন, যেখানে চলতি বছর উৎপাদন হয় সাড়ে ৩৪ লাখ টনেরও বেশি। সাধারণত মার্চ এপ্রিলে পেঁয়াজ ঘরে তোলেন কৃষক। এরপর জুন-জুলাই পর্যন্ত তা সংরক্ষণে রেখে বিক্রি করা যায়। তবে এ বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যটির দাম। মাঝে কিছুদিন প্রতি কেজি ৯০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে।

আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৭৫-৮০ লাখ টন। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ টন, যেখানে গত অর্থবছরে হয়েছিল ১ কোটি ১ লাখ টন। এরপরও দেশের বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা করে। যদিও গত বছর এ সময়ে আলুর কেজি ছিল ২০-২৫ টাকা। 

এছাড়া ডিএইর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর দেশে শাকসবিজ উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ১৬ লাখ টন। আর চলতি বছর এ পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে। তেলজাতীয় ফসল গত বছরের চেয়ে প্রায় ২ লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে। ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৪ লাখ টন বেশি। প্রায় ২ লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে গম। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরবরাহ যত বেশি থাকবে খাদ্যপণ্যের দাম তত নিয়ন্ত্রিত থাকার কথা। কিন্তু দেশের বাজারে খাটছে না অর্থনীতির এ সূত্র। 

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। তবে সেটা ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের পিংক শিটের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় প্রতি টন গমের মূল্য ৩৪২ দশমিক ৯ ডলার হলেও এ বছরের এপ্রিলে ছিল ২৯১ দশমিক ১ ডলার। সয়াবিন তেলের দাম গত বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে প্রতি টন ছিল ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। যদিও চলতি বছরের এপ্রিলে দাম নেমেছে ১ হাজার ৩০ ডলারে। দেশের বাজারে যদিও কমার বদলে উল্টো দাম বেড়েছে। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘সরবরাহ বাড়া-কমার সঙ্গে দাম নির্ধারণ হবে, এটাই অর্থনীতির নিয়ম। কিন্তু এর মাধ্যমে দাম নির্ধারণ না হয়ে ক্ষমতা ও ক্ষমতার সঙ্গে ভাগাভাগি করে দাম নির্ধারণের কারণে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি চলমান।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরবরাহ বা আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে তা কমেনি বরং বাড়ছে। মূলত দাদন ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, মিল মালিকরা বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়। অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগীরা কাঠামোগতভাবে মূল্য নির্ধারণ করে। আবার খুচরা ও পাইকারি বাজার মিলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের নেটওয়ার্ক রয়েছে, যারা বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। ফলে সরবরাহের সঙ্গে দামের যে সম্পর্ক সেটা আর হয় না। কৃষক দাম পায় না।’ 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘এক সময় বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছিল। এখন বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় তারা লোকসানে পড়ে গেছেন, দাম কমাতে পারছেন না। উল্টো যেগুলো আমরা নিজেরা উৎপাদন করি সেগুলোর দামও বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অজুহাত মাত্র।’

তদারকির অভাবে পণ্যের দাম বাড়ছে মন্তব্য করে এ বাজার বিশ্লেষক বলেন, ‘পুরো ভোগ্যপণ্যের বাজার তদারকির মধ্যে নেই। পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও কয়েক দিনের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কোনো কারণ ছাড়াই যদি প্রতিটি পণ্যের দাম এভাবে বেড়ে যায়, তাহলে তো বড় সমস্যা। দেশীয় উৎপাদনের সঙ্গে ডলারের সম্পর্ক কী? সরকারের মনিটরিং দুর্বলতার কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। নইলে এ বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ নেই বর্তমানে।’ 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার যদিও বলেন, ‘খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পিছনে সার্বিক মূল্যস্ফীতির একটা প্রভাব রয়েছে। তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে। আর প্রতিটি জায়গায় পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূলত বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //