গরমিলের অর্থনীতি

নতুন বছর শুরু হয় নতুন প্রত্যাশায়। প্রত্যাশা আরো বাড়ায় নতুন সরকারের হাত ধরে যাত্রা শুরু করা ২০১৯ সাল। কিন্তু প্রত্যাশিত গন্তব্যে যেতে পারেনি দেশের অর্থনীতি। সামষ্টিক অর্থনীতির শক্তিশালী প্রবণতা ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। দুয়েকটি সূচক ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকই নেতিবাচক ধারায় ধাপিত হয়েছে।

২০১৯ সালের সাফল্য শুধু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স আয়ে। বেসরকারি বিনিয়োগ, সরকারের আয়, আমদানি, রফতানি বছরের শুরুর দিকের তুলনায় শেষের দিকে এসে কমে গেছে।

পুঁজিবাজারের সংকট আরো প্রকট হয়েছে। সুদহারের মারপ্যাঁচের মধ্যে প্রকট হয়েছে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের সংকট। এদিকে, সরকারের তরফে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ার কথা বলা হলেও প্রবৃদ্ধির সূচকগুলোর দুর্বল অবস্থান ওই প্রতিচ্ছবির প্রতি সন্দেহ তৈরি করেছে। 

কয়েকদিন পরই বিদায় নেবে ২০১৯ সালে। এখন চোখ আয়-ব্যয়ের হিসাবে। প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ডালিতে। অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ শুরুর দিকের তুলনায় শেষের দিকে এসে হতাশ করেছে। তবে আশার আলো ছড়িয়েছে জিডিপির প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারাবাহিকতা। গত অর্থবছরের খসড়া হিসেবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৮.১৩ শতাংশ। চূড়ান্ত হিসাবে তা আরো বেড়ে হয়েছে ৮.১৫ শতাংশ।

দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়লেও অপরিবর্তিত রয়েছে নাগরিকদের গড় মাথাপিছু আয়। রেকর্ড প্রবৃদ্ধির বছরে বাংলাদেশিদের বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯০৯ ডলার বা ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৪০ টাকা। এদিকে কমেছে দরিদ্র জনসংখ্যার হারও। আগের অর্থবছরে দারিদ্যের হার ২১.৮ শতাংশ, গত অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ২০.৫০ শতাংশ।

এর বাইরে অর্থনীতির আরেকটিমাত্র ইতিবাচক সূচক রফতানি আয়। ২০১৯ সালের এগার মাসে (জানুয়ারি-নভেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৬৬৬ কোটি ডলার। ২০১৮ সালে পুরো বছরে রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি ডলার। তবে রেমিট্যান্স আয় বাড়লেও শ্রমিক রফতানিতে হতাশা বাড়ছে। বছরজুড়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন অনেক নারী গৃহশ্রমিক। অবৈধ অভিবাসীদের ২০১৯ সালের মধ্যেই ফেরত পাঠাচ্ছে মালয়েশিয়া। নতুন করে কোনো দেশে বাজার সৃষ্টি হয়নি, কিন্তু প্রচলিত বাজারে শ্রম রফতানি প্রায় বন্ধ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সার্বিকভাবে অর্থনীতির যে চাঙাভাব আশা করছি, তা আর থাকবে না। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের অর্থনীতি সংকটের মধ্যে পড়েছে। আমরাও সংকটে পড়তে যাচ্ছি।  প্রবাসী আয় বাড়লেও প্রবাসীর সংখ্যা কমছে। ভবিষ্যতে প্রবাসী আয় আসার প্রবণতাও কমে যাবে।’

বছরজুড়ে আলোচনা ছিল জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যোগফল বাড়লেও সংখ্যা (সূচক) নিয়ে প্রশ্ন ছিল। অধিকাংশ সূচকের নেতিবাচক অবস্থান সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে শিল্পখাতের উপর ভর করেছে। সরকারের হিসাবে শিল্পের উৎপাদন বাড়লেও কমেছে রফতানি, শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ও কর্মসংস্থান।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি এখন সুতা কাটা ঘুড়ির মতো। বাস্তবতার সঙ্গে সুতার যে সংযোগ থাকে, সেটা এখানে নেই। জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ২৩ শতাংশে রয়েছে। অথচ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ থেকে ৬ এবং ৭ ছাড়িয়ে ৮ শতাংশে গেছে। বাড়তি ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ব্যতিরেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির উৎস কী—এতে আমরা চিন্তিত। বেসরকারি খাতে ঋণ সর্বকালের মধ্যে কম, ব্যাংকের তারল্যের সংকট, ব্যাংক টাকা ফেরত পাচ্ছে না, শেয়ারবাজারে সংকট অথচ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ফলে সরকারের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।’

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হয় চলতি অর্থবছরে। কিন্তু বাজট বাস্তবায়নে হোঁচট খাওয়ার মতো গর্ত বাড়ছে প্রতিমাসেই। বিপুল ব্যয়ের বিপরীতে প্রতিমাসেই কমছে সরকারের আয়। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় উৎসের আয়ে হোঁচট খাচ্ছে সরকার।  আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও শুল্ক—জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের প্রধান তিনটি খাত।

সরকার রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা নিয়ে বছর শুরু করে প্রকৃত অর্জন তার ধারে কাছেও নেই। গত অর্থবছরে প্রকৃত আদায়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। কিন্তু জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসরবে রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ২.৬২ শতাংশ। গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছিল ৭২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। এবার তিনমাসেই ঘাটতি হয়েছে ২০ হাজার ২২০ কোটি টাকা।

দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধি বছরের শেষ সময়ে এসে আরো কমছে। সর্বশেষ হিসাবে গত নভেম্বরে রফতানি কমেছে ১০.৭০ শতাংশ। আগের বছরের নভেম্বরে রফতানি আয় ১২ শতাংশ বেড়েছিল। সব মিলিয়ে অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রফতানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের তুলনায় ৭.৫৯ শতাংশ কম এবং চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ কম। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রফতানি ও আমদানি কমে যাওয়া এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির মন্দার কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে গেছে। এরই প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে।

রাজস্ব আদায় কম হলেও সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় থামানো সম্ভব নয়। এই ব্যয় মেটাতে সরকার ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই মুহূর্তে সরকারের ঋণের প্রধান উৎস অভ্যন্তরীণ খাত। বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি সরকারের ঋণের উৎস। এই দুই খাত থেকে ইতোমধ্যে ৫২ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। 

চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। যা বাজেটে পুরো বছরের জন্য ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার ৯৯.৫৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছর শেষে সরকার ব্যাংক থেকে নিট ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ঋণের জন্য সংকটে থাকা বেসরকারি খাতের ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে সরকার। আলোচ্য সময়ে নেওয়া ঋণের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ৩৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে চলতি বছরের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের স্থিতি বা পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪৩ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিয়েছে ৫ হাজার ৫২১ কোটি টাকা।

ব্যাংকখাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়ে ২০১৯ সাল শুরু হয়। বিশেষ করে দুর্নীতি ও জালিয়াতির কারণে সৃষ্ট পাহাড়সম খেলাপি ঋণ কমানোর ঘোষণা দেন নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। খেলাপি ঋণ কমাতে ছাড়ের ফর্মুলা ব্যবহার করা হয়। এই ছাড়ের আওতায় বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ নিয়মিত হয়েছে। কিন্তু এরপরও মাত্র ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এটি বেড়ে গত সেপ্টেম্বরে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। 

ব্যাংক খাতের নয়-ছয়ের কারণে ঋণের সুদহার না কমলেও আমানতের সুদহার কমে যায়। টাকা জমানোর আরেকটি খাত ছিল সঞ্চয়পত্র। অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করে সেখানে মানুষদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এখন অর্থ বিনিয়োগের একমাত্র ক্ষেত্র থাকে পুঁজিবাজার। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আস্থাহীনতায় বাজারে ঠকছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম দিন ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ ১৯ ডিসেম্বর ডিএসইর মূলধন ৩ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে। আলোচ্য সময়ে ডিএসইর মূলধন কমেছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। লেনদেনেও ছিল ব্যাপক খরা। বছরের শুরুতে ডিএসইর লেনদেন ছিল ৫০০ কোটি টাকার ওপর। সেই লেনদেন কমতে কমতে নেমেছে ২০০ কোটি টাকার ঘরে। আর সূচক কমেছে ১ হাজার পয়েন্ট। বছরের শুরুতে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৪৬৫ পয়েন্ট। সেটি কমে ৪ হাজার ৪৫৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘শেয়ার বাজারের সংকট একদিনের নয়। অনেক দিন থেকে চলে আসছে। বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট রয়েছে। এ আস্থা ফিরে আনতে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিচার করার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়তা দিতে হবে, কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার পুঁজি হাতিয়ে নিলে এর বিচার হবে।’

অর্থনীতির আরেকটি স্বস্তিদায়ক দিক ছিল মূল্যস্ফীতি। মূল্য বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের। তবে পেঁয়াজ নিয়ে ঘটেছে লঙ্কাকাণ্ড। গত বছর ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৩৫ শতাংশ। সর্বশেষ গত নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.০৫ শতাংশ। 

সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রবাসী আয় ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকেই মন্দার আভাস। রাজস্ব, রফতানি, ঋণ—এসব কোনোটির পরিস্থিতিই তেমন ভালো নয়। আগে একসঙ্গে এত সূচকের খারাপ অবস্থা দেখা যায়নি। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি আগের চেয়ে কমে যাওয়ার মানে হলো বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিনিয়োগ আনতে বড় সংস্কার লাগবে। নগদ সহায়তা বা কর সুবিধার মতো প্রণোদনা দিয়ে কাঠামোগত সমস্যা দূর করা যাবে না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //