পুনরুদ্ধারের মুদ্রানীতি, লক্ষ্যেও সমাধান নেই

কভিড-১৯ মহামারির জন্য বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত, ভঙ্গুর, সমস্যায় জর্জরিত ও ক্ষতিগ্রস্ত। মুদ্রানীতির মূল চ্যালেঞ্জগুলো হলো- মহামারির দীর্ঘসূত্রতা ও অনিশ্চয়তার কারণে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পুনরুদ্ধারের গতি-প্রকৃতি বাধাগ্রস্ত হওয়া; করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক যেসব প্রণোদনা, ঋণ ও বিনিয়োগ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে উৎপাদন ও কর্মসৃষ্টি সহায়ক উপায়ে বাস্তবায়িত না হলে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিসহ অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যস্ফীতি সৃষ্টির সম্ভাবনা; বৈশ্বিক চলমান অর্থনৈতিক মন্দার দীর্ঘসূত্রতার কারণে দেশের রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব এবং চলমান বন্যার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা। মুদ্রানীতির সামনে এগুলো এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

বিশ্লেষকদের মতে, অর্থগুলো সঠিক জায়গায় না পৌঁছালে আরো যে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, সে বিষয়ে প্রতিরোধ, প্রতিকার বা অর্থের দুর্ব্যবহার-অপব্যবহার রোধে শক্ত কোনো পদক্ষেপের কথা এবারের মুদ্রানীতিতে উল্লেখ নেই। সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমদের মতে, গতানুগতিক বাজেটের মতোই, গতানুগতিক মুদ্রানীতি। যার লক্ষ্য আছে, নেই সমাধান।

বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ মহামারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং সরকারের নির্ধারিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সম্প্রতি চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) মুদ্রানীতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতির লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন সুদহারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তহবিল সংকট দেখা দিলে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্ধারিত যে সুদহারে অর্থ সংগ্রহ করে, সেটাই হচ্ছে রেপো রেট। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এ মূল সুদহারটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এখন এটি ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৪.৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।

অন্যদিকে, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত ঋণের সুদহার নির্দেশ করে রিভার্স রেপো রেট। রিভার্স রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। এ ক্ষেত্রে সুদহার ৭৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে ব্যাংক সুদহারে। যা ১০০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও করোনাভাইরাসের কারণে পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের সুদ শূন্য শতাংশও করা হয়েছে- এসব উদ্যোগ কতটা কাজে আসবে, তা সময়সাপেক্ষ। সরকার বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তারই একটি চিত্র এই মুদ্রানীতি। বাজেটে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার, যা বাজেটের সাড়ে ৪৪ শতাংশের কাছাকাছি। মুদ্রানীতিতে সেটিই উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৯-২০ মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১৪.৮ শতাংশ ধরা হয়েছিল; কিন্তু মহামারির ধাক্কায় ওই প্রবৃদ্ধি এ যাবতকালের সর্বনিম্ন ৮.৬১ শতাংশে নেমে এসেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অর্থবছরের মতো এত কম প্রবৃদ্ধি এক দশকে হয়নি। ফলে এবার কভিড-১৯ ও বন্যার কারণে সেটি কতটা অর্জিত হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, করোনাভাইরাস মহামারি, বন্যা, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাভাব এবং আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতার ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এ মুদ্রানীতি করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হলো- চলমান মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং সরকার নির্ধারিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে আর্থিক খাতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করা। যার মূল কাজ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক, অর্থাৎ কভিড-১৯ পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

এদিকে, প্রণোদনা ঘোষণার চেয়ে তার সঠিক ও সুষ্ঠু বাস্তবায়নকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার। বর্তমান বাস্তবতায়, ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে মাসভিত্তিতে ব্যাংকের ঋণসংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, কোন খাতে কেমন ঋণ যাচ্ছে, বা বিতরণ করা হয়েছে। বিপর্যস্ত এই সময়ে সব শ্রেণির উদ্যোক্তারই কম সুদে ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন। করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে হলে অধিকসংখ্যক ব্যবসায়ীকে সহায়তা দিতে হবে। কারণ সব শ্রেণির ব্যবসা-বাণিজ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

বিশ্লেষকরা এই মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যারা এই ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিতে নিজেরা বিপর্যস্ত, তারা ঋণ পাবে কি না, তা নিয়ে যেমন সন্দেহ আছে, তেমনি কভিড-১৯ ও বন্যার কারণে অর্থনীতিতে নতুন অনেক চ্যালেঞ্জ এসেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুদ্রানীতিতে শুধু কিছু লক্ষ্য দেয়া হয়েছে; কিন্তু কীভাবে এসব লক্ষ্য অর্জিত হবে, তা মুদ্রানীতিতে উল্লেখ নেই। কোনো সমাধানের কথাও বলা হয়নি। এবারের বাজেট যেমন গতানুগতিক হয়েছে, তেমনি মুদ্রানীতিও গতানুগতিক। অতীতের মতো এই মুদ্রানীতিকে সম্প্রসারণশীল বলা হয়েছে; কিন্তু এই সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই।

মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে। অথচ যেখানে ভোক্তা চাহিদাই নেই, সেখানে মূল্যস্ফীতি হবে কীভাবে? আবার বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৪.৮ শতাংশ; কিন্তু কীভাবে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ বাড়ানো হবে কিংবা ঋণপ্রবাহ বাড়ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের কোনো উদ্যোগের কথা মুদ্রানীতিতে বলা হয়নি। এখন ঋণপ্রবাহ রয়েছে ৮ শতাংশের মতো। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা নেই। ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। ঋণের সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংকগুলো কী করছে, এ নিয়ে এক মাস কিংবা তিন মাস পরপর পর্যবেক্ষণ করা উচিত। 

রেপো হার কমিয়ে তারল্য বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে; কিন্তু ঋণের চাহিদা নেই। শুধু লক্ষ্যনির্ভর গতানুগতিক এই মুদ্রানীতি দিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মুদ্রানীতির লক্ষ্য অর্জনে বাস্তবতার ভিত্তিতে একটি কর্মপরিকল্পনা থাকা উচিত। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। গতানুগতিক মুদ্রানীতি দিয়ে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে না। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মুদ্রানীতি দেয়া হলেও দফায় দফায় প্রজ্ঞাপন দিয়ে নানা সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। এসবই যদি হয়, তাহলে এক বছরের জন্য মুদ্রানীতি দিয়ে কী লাভ হবে?

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অর্থের সংকট হবে না, তারল্যে জোগানও দেয়া সম্ভব হবে। এমন বার্তাই মুদ্রানীতিতে দেয়া হয়েছে। মূলত কভিড-১৯ মহামারির শুরুতেই সংকুলান থেকে সম্প্রসারণে ঢুকে পড়ে মুদ্রানীতি। সে বিবেচনায় ঘোষিত মুদ্রানীতিকে সময়োপযোগী বলা যায়; কিন্তু অর্থ সঠিক জায়গায় না পৌঁছালে আরও বড় বিপর্যয় নেমে আসার শঙ্কা রয়েছে। সে বিষয়ে প্রতিরোধ, প্রতিকার বা অর্থের দুর্ব্যবহার-অপব্যবহার বন্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপের কথা মুদ্রানীতিতে আমরা পাইনি। যেটা প্রয়োজন ছিল।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //