ডলার নিষেধাজ্ঞার শঙ্কায় ইউয়ানে জোর চীনের

শীর্ষ দুই অর্থনীতি, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সমাপ্তির আভাস বেশ কয়েকবার পাওয়া গেলেও তা এখানো বাস্তবরূপ পায়নি। বরং এই বিবাদ উসকে দেয়ার মতো সম্প্রতি নতুন আরেক ইস্যু সৃষ্টি হয়েছে। 

শোনা যাচ্ছে, ডলার নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্ক সুইফট থেকে চীনকে বের করে দেয়ার পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা চীনের জন্য রীতিমতো দুরূহ হয়ে উঠবে। 

এমন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক যুদ্ধ আরো ঘনীভূত হবে, যার ফলাফল হিসেবে বৈশ্বিক ডলার ব্যবস্থাপনাটাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে চীন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে তারাও বসে থাকবে না, তারাও পাল্টা পদক্ষেপ নেবে।

গত বছর থেকেই চীন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে। চীনে প্রযুক্তিপণ্য রফতানি কমাতে বেইজিংয়ের আমদানিকৃত পণ্যে শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে এই বিবাদের সূত্রপাত। এরপর জল বহুদূর গড়িয়েছে। চীন থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে এমন অনেক মার্কিন কোম্পানিই শাস্তিমূলক শুল্ক এড়াতে বেইজিং ছেড়ে চলে গেছে। অন্যদিকে মার্কিন পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে চীনও। 

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এ তিক্ততা বিশ্বে প্রযুক্তি সরঞ্জাম নির্মাণকারী শীর্ষ কোম্পানি হুয়াওইয়ের জন্য দুর্দশা বয়ে এনেছে। চীনকে পরাস্ত করতে প্রায় সব ধরনের অস্ত্রই প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন সর্বশেষ হাতিয়ার হিসেবে ডলার ক্লিয়ারিং ও সেটেলমেন্টের আর্ন্তজাতিক ব্যবস্থা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনে (সুইফট) চীনের অবস্থান সীমিত অথবা একেবারে বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। 

সুইফট একটি আন্তর্জাতিক মানের পেমেন্ট ব্যবস্থা; যেখানে ডলারে ব্যবসা, স্থানান্তর, বিনিময় ও বিশ্বব্যাপী মজুদ করা হয়। সুইফটের প্রধান মুদ্রা ডলার এবং এটি মার্কিন সরকারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। কোনো দেশ বা অঞ্চলকে শাস্তি দেয়ার জন্য সুইফটকে রীতিমতো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। ইরান, ভেনেজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে এই অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়েছে, এই দেশগুলো এখন আর ডলারের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারে না। চীনও এর শিকার হলে আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যবসা পরিচালনা করা দুষ্কর হয়ে পড়বে। 

চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে বিরাগভাজন হয়ে ওঠার কারণ বিতর্কিত নতুন হংকং নিরাপত্তা আইন। গত মাসে এই আইনটি পাস করানোর মধ্য দিয়ে আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটির ওপর নতুন ক্ষমতা পায় চীন। হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থীরা এই আইনের ঘোর বিরোধী হলেও চীনের দাবি এ অঞ্চলটির বিচ্ছিন্নতাবাদ, বৈধ সরকার পতনে সহিংস কার্যক্রম, সন্ত্রাসবাদ ও বিদেশি হস্তক্ষেপ রুখতেই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। 

চীনের এ পদক্ষেপের পর মার্কিন কংগ্রেসে স্বায়ত্তশাসন আইন পাস হয়েছে। এতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বাক্ষরও করেছেন। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জারি করা এক নির্বাহী আদেশে বলা হয়, হংকংকে দেয়া বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা বিলুপ্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন সরিয়ে নেয়ার জন্য দায়ী চীনা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান- বিশেষ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়।

নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে এমন লোকদের সাথে লেনদেন অব্যাহত থাকলে চীনের ব্যাংকগুলোর ডলার অ্যাকসেস বন্ধ করে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞায় চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও ব্যাংক অব চায়না (বিওসি), ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না, চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংকের ডলার অ্যাকসেস সীমিত করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনটা করা হলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে প্রতিষ্ঠানগুলো। 

ব্লুমবার্গের দেয়া তথ্যানুযায়ী, শুধু গত বছরই এ চারটি ব্যাংকের ডলার লেনদেন ছিল ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার। এছাড়া চীনের ব্যাংক ও রোড অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের সাথেও যুক্ত এসব প্রতিষ্ঠান। ফলে চীনা ব্যাংকগুলোর ডলার অ্যাকসেস বন্ধ হলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে দেশটি।

এমন পরিস্থিতিতে চীনও বসে নেই। ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে নানা উপায় সন্ধান করছে দেশটি। যার মধ্যে অন্যতম আন্তর্জাতিক মুদ্রাঝুড়িতে স্থানীয় মুদ্রা ইউয়ানের প্রবেশ ঘটানোর প্রচেষ্টা জোরদার করা। এরইমধ্যে বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলছেন, চীনের তৈরি করা কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের মতো পণ্য ইউয়ানের মাধ্যমে রফতানির চিন্তাভাবনা চলছে। এছাড়া মুদ্রাটির ডিজিটাল ভার্সন ব্যবহার করে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা আরো কমাতে চাইছে চীন। 

এ প্রসঙ্গে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়নার (পিবিসি) সাবেক অর্থনীতিবিদ ও লন্ডনভিত্তিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের অর্থনৈতিক গবেষণা বিভাগের প্রধান শোয়াং ডিং বলেন, ‘ইউয়ানের আন্তর্জাতিকীকরণ ভালো সমাধান। এটি এখন অতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এখন পরিষ্কার ও চলমান।’ 

যদিও বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতি একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসন মূলত বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে চীনকে আংশিকভাবে পৃথক করে ফেলতে চাইছে। আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই পক্ষের উত্তেজনা আরো বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

চায়না একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের (সিএএসএস) অর্থনীতিবিদ ইয়ো ইয়ংডিং বলেন, ‘ইতিমধ্যে বিস্তৃত পরিসরে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে কড়া হাতিয়ারটি এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়নি।’ 

তিনি আরো জানান, চীনের বিরুদ্ধে যে চরম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, তারমধ্যে বেইজিংয়ের হাতে থাকা মার্কিন সম্পদও রয়েছে। তবে এ ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা আত্মঘাতী হবে। 

উল্লেখ্য, চীনের মালিকানায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ রয়েছে। মার্কিন নেতাদের ‘উগ্রবাদী’ আখ্যা দিয়ে ইয়ো বলেন, চীনকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা একেবারেই অসম্ভব নয়। আর এ কারণেই চীনের প্রস্তুতি নিতে হবে।

উচ্চ ঝুঁকি

চীনকে ডলার সিস্টেম থেকে বের করে দেয়া হলে অথবা পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বেইজিং যদি তাদের কাছে থাকা মার্কিন ঋণের বড় অংশ বিক্রি করে দেয় তাহলে তা আর্থিক বাজারকে আলোড়িত করবে এবং এতে বৈশ্বিক অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে এই মুহূর্তে প্রচুর ঝুঁকি বিরাজ করছে।

জ্যেষ্ঠ সিকিউরিটিজ রেগুলেটর ফ্যাং শিংহাইয়ের মতে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় চীনকে চরমভাবে ভুগতে হতে পারে। আর এ জন্য দেশটিকে ‘দ্রুত’ ও ‘কার্যকর’ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এরইমধ্যে রাশিয়ার অনেক ব্যবসা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে এমনটা ঘটেছে।

চীনের স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব ফরেন এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক ও বিওসি ইন্টারন্যাশনালের (চায়না) প্রধান অর্থনীতিবিদ গোয়ান তাও মনে করেন, বেইজিংয়ের এখনই প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ডলার সেটেলমেন্ট সিস্টেম থেকে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বের করে দেবেই- মানসিকভাবে এমন প্রস্তুতি নেয়া উচিত।’

গত মাসে প্রকাশিত গোয়ান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউয়ান সেটেলমেন্ট সিস্টেমের ‘দ্য-ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম’ ব্যবহার বৃদ্ধির আহ্বান জানান। বর্তমানে চীনের বেশিরভাগ আন্তঃসীমান্ত লেনদেন সুইফট সিস্টেমের মাধ্যমে ডলারে সম্পন্ন হয়। অনেকে বলছেন সুইফট থেকে চীন বের হয়ে গেলে এ ব্যবস্থাটিও ভেঙে পড়বে।

নতুন উদ্যোগ

পাঁচ বছর পর চীন আবার নতুন করে ইউয়ানের আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত মাসে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাংহাই কার্যালয় থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইউয়ানে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধির আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রাকে অগ্রাধিকারের পরামর্শও দেয়া হয়। 

অন্যদিকে চীনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান ইয়ে গ্যাং সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইউয়ান আন্তর্জাতিকীকরণের প্রক্রিয়া বেশ ভালোভাবেই চলছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথমার্ধে ইউয়ানের মাধ্যমে চীনের আন্তঃসীমান্ত লেনদেন ৩৬.৭ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভে ইউয়ানের পরিধিও বেড়েছে। সুইফট থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সুইস ফ্রাঁকে হারিয়ে পঞ্চম সর্বাধিক ব্যবহৃত মুদ্রার স্থান দখল করেছে ইউয়ান। তবে চীনের কঠোর পুঁজি নিয়ন্ত্রণের কারণে ইউয়ানের আন্তর্জাতিকীকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া করোনাভাইরাস থেকে শুরু করে হংকংয়ের ঘটনার কারণে বিভিন্ন দেশের বাধার মুখেও পড়তে পারে চীন।

বিভিন্ন আন্তঃসীমান্ত চুক্তির ক্ষেত্রে ইউয়ানের মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণের বিষয়েও চিন্তা করছে চীন সরকার। সিঙ্গাপুরভিত্তিক ওসিবিসি ব্যাংকের চীন বিষয়ক গবেষক টমি শিয়ে বলেছেন, সম্ভাব্য করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন রফতানিতে ইউয়ানে দাম নেয়া হতে পারে। 

এছাড়া বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ডিজিটাল ইউয়ান ব্যবহারের কথাও বলেছেন সাংহাই ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডিং জিয়ানপিং।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //