ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত অর্থনীতি; কিন্তু ব্যতিক্রম বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। খেলাপি ঋণ বাড়ছে না, ব্যাপকহারে মুনাফা হচ্ছে! মূলত নীতিগত ছাড় দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে ব্যাংকিং খাতকে কাগজে-কলমে সাজানো-গোছানো দেখানো হচ্ছে; কিন্তু অর্থনীতির অন্য খাতের মতো ব্যাংক খাতও বিপর্যস্ত বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।  বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণেই এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশে শুরু হয়েছে ৮ মার্চ থেকে। দুই মাসের সাধারণ ছুটির পর মে মাসের শেষের দিকে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলেও তাতে গতি আসেনি। শিল্পপণ্যের চাহিদা কম থাকায় আমদানি কমেছে। বিদেশে রফতানিও কমেছে। এতে বিপুল পরিমাণ মানুষ এখনো পুরোদমে কাজে যোগ দিতে পারেননি। অনেকে কাজে যোগ দিলেও তাদের আয় আগের পর্যায়ে নেই। তবে এসব সংকটের প্রভাব বাহ্যত দেখা যাচ্ছে না ব্যাংক খাতে। কারণ ব্যাংক খাত নীতিগত নানা সুবিধা ভোগ করছে। এ খাতের মূল সমস্যা খেলাপি ঋণ, যার তথ্য নিয়ে আগে থেকেই সন্দেহ রয়েছে। করোনাভাইরাসের মধ্যে জানুয়ারি থেকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো গ্রাহক টাকা ফেরত না দিলেও তাকে খেলাপি করা হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ছাড়ের কারণে ‘ব্যাংক খাতের ক্যান্সার’ খেলাপি ঋণ এই বছর বাড়বে না। 

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন  বলেন, ‘এই খাতের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো অ্যাসেট কোয়ালিটি। রিপোর্টেড নন-পারফর্মিং লোন এবং ডিসট্রেসড অ্যাসেট যোগ করলে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়। ‘ডিসট্রেসড এসেট’ সৃষ্টির বড় কারণ- রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিতরণ ও আদায় করে থাকে। খেলাপি ঋণের পুনঃতফসিল সুবিধা ও কভিড পরিস্থিতির কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি না দিলেও কেউ খেলাপি হচ্ছে না। কভিডে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ হয়েছে। তাই ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের পাশাপাশি অনিচ্ছাকৃতরাও খেলাপি হবেন। এখন মোরাটোরিয়াম পিরিয়ডের কারণে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না; কিন্তু যখন মোরাটোরিয়াম থাকবে না, তখন খেলাপি ঋণের পুঞ্জিভূত আকার অনেক বড় হয়ে সামনে আসবে।

এদিকে, সম্প্রতি ‘ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর স্ট্যাবিলিটি রিভিউ ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনের খসড়া তৈরি করেছে আইএমএফ। প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করতে বাংলাদেশের বক্তব্য ও ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে। ওই খসড়া প্রতিবেদনের তথ্যগুলো নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করে, বাস্তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ তার চেয়েও অনেক বেশি। বড় বড় গ্রাহকদের বারবার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের  সুবিধা দেয়া ও উচ্চ আদালত থেকে সাময়িক স্থগিতাদেশ নিয়ে ঋণখেলাপিরা বাড়তি সুবিধা নিচ্ছে। এটি বন্ধের সুপারিশ করেছে আইএমএফ। 

উল্লেখ্য, গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত আইএমএফের সর্বশেষ ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর স্ট্যাবিলিটি রিভিউ প্রতিবেদনে ওই বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের প্রকৃত খেলাপি ঋণ দুই লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করেছিল। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গত জুনের প্রতিবেদন অনুসারে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৯৭ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। 

এ বিষয়ে  বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও ব্যাংকগুলোর মধ্যে ভালো করার চেষ্টা ছিল, যা এখন আর নেই। ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব আছে। খেলাপি ঋণও বাড়ছে। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং ও সুপারভিশনের ঘাটতিই এর জন্য দায়ী। বেশিরভাগ ব্যাংকই সাজিয়ে-গুছিয়ে খেলাপি ঋণের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায়। সেসব তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যাচাই করা উচিত। খেলাপি ঋণের তথ্যের জন্য ব্যাংকগুলোর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা ঠিক নয়।’

কয়েক বছরে ব্যাংক খাতের অবস্থা খারাপ হওয়ার প্রধানতম কারণ রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থের প্রাধান্য। আইনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে, বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি। রাজনৈতিক খেয়ালখুশি মোতাবেক পরিবর্তন হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মকানুন। ব্যক্তি স্বার্থকে রক্ষা করা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেশের আর্থিক খাতকে সংকটে ফেলে দিচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের; কিন্তু অর্থনীতির প্রয়োজন না থাকলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নতুন নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করেছে সরকার। ফলে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কতিপয় ব্যক্তির হাতে দীর্ঘমেয়াদে বন্দি হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন একই পরিবারের দুই সদস্যের পরিবর্তে চার সদস্য এবং ৬ বছরের পরিবর্তে ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন।

ব্যাংক খাতের কিছু সংকট স্বীকার করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ও। তবে সংকট সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হলেও, তা নেয়া হয়নি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘চিহ্নিত ঝুঁকি দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। ঝাড়ু দিয়ে ময়লা কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। দেশ যেভাবে এগোচ্ছে, ব্যাংক খাত সেভাবে না এগোলে সংকট বাড়বে।’ অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আইএমএফ আমাদের আর্থিক খাতের বেশকিছু দুর্বল পয়েন্ট চিহ্নিত করেছে। এগুলো দূর করতে উদ্যোগ নেয়া উচিত। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার।’

আইএমএফ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা স্বায়ত্তশাসনের সক্ষমতা ও দক্ষতায়। ব্যাংক খাত পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিতেও কেন্দ্রীয় বাংকের ঘাটতি রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের খবরদারি রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে কিছু সুপারিশ করেছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, ব্যাংকের মালিকানা ও সুপারভিশন আলাদা করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক- এই দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বাড়ানো, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্সিং স্কিমগুলোকে পৃথক কোনো ডেভেলপমেন্ট বা ফিসক্যাল এজেন্সির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা, ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি কাউন্সিল গঠন এবং রিয়েল এস্টেট সেক্টরের মর্টগেজ পরিস্থিতি নিয়মিত নিবিড় পর্যালোচনায় রাখতে ন্যাশনাল রিয়েল এস্টেট টাস্কফোর্স গঠন করতে বলেছে আইএমএফ। আর্থিক খাতের ঝুঁকি দূর করতে ২৮টি ক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব করেছে আইএমএফ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো আাগে থেকেই চিহ্নিত। খেলাপি ঋণ লুকানো হচ্ছে পুনঃতফসিল করে। আইএমএফের হিসাবে, রিসিডিউল করা ঋণের সঙ্গে মামলায় আটকে থাকা খেলাপি এবং অন্যান্য ডিসট্রেসড এসেটও যোগ করা হয়। কোভিডের আগে বাংলাদেশে এটি ছিল মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ থেকে ২৫ শতাংশের মতো।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //