স্থবিরতার চক্রে অর্থনীতি

মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ধাক্কা সামলে দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। এতে মারাত্মক অচলাবস্থার অবসান ঘটে, কিছুটা গতিময়তা আসে; কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কা শুরুর আগেই অর্থনীতিতে আবার ভর করছে স্থবিরতার চক্র। 

বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ, শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় আমদানি কমে গেছে। অর্থাৎ নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না, আগের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক উৎপাদনে নেই। এই স্থবিরতা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান কমিয়ে দেবে। চক্রাকারে এই নেতিবাচক প্রবণতা কাক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন শঙ্কার মধ্যে ফেলে দেবে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে নতুন করে সহায়তা তহবিল ও বাস্তবায়ন কাঠামো তৈরি করতে হবে। 

জানা যায়, অর্থনীতির স্বাভাবিক চক্র হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থা, সেবা ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বাজার ব্যবস্থাপনার স্বাভাবিক গতিতে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। এই চক্রের যেকোনো একটি প্রভাবিত হলে তা পুরো চক্রকে অকার্যকর বা শ্লথ করে দিতে পারে। মহামারি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগেই উৎপাদন ও সেবা খাতে বিনিয়োগ চাঙ্গা রাখতে যেভাবে ঋণ প্রবাহ রাখা দরকার তা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা পরবর্তী ধাপগুলোকেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলছে। 

  • ঋণ বিতরণ তলানিতে
  • ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড়
  • কমছে আমদানি
  • বিনিয়োগ মন্দায় কর্মসংস্থান কমবে

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হচ্ছে বেসরকারি ঋণ। সেই ঋণ যদি না বাড়ে, তাহলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে না। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল; কিন্তু আবারও হোঁচট খেলো মনে হচ্ছে। বেসরকারি ঋণপ্রবাহে যে গতি এসেছিল, সেটিও ধাক্কা খেয়েছে। সবকিছুই অনিশ্চিত এখন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কমতে কমতে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮.৬১ শতাংশে নেমে এসেছিল। প্রণোদনা ঋণে ভর করে এই প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করে; কিন্তু বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানিতে নেমেছে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা বিতরণ করায় গত তিন মাসে ঋণ বিতরণ বেড়েছে; কিন্তু অক্টোবরে এসে তা আবার কমে গেছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯.২০ শতাংশ। আগস্টে তা বেড়ে ৯.৩৬ শতাংশে উঠে। সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে ৯.৪৮ শতাংশ হয়। অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ পয়েন্ট কমে আবার ৮.৬১ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসেই সর্বনিম্ন।

অর্থনীতির গবেষক ও ব্যাংকাররা বলেছেন, কভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় সরকার সোয়া লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নে গতি আসায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল। এখন প্রণোদনা ঋণ তেমন বিতরণ না হওয়ায় এই প্রবৃদ্ধি ফের সেই তলানিতে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৪ হাজার ৩২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৫ হাজার ৯৫৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, টানা প্রায় ১০ বছর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্ক বা ১০ শতাংশের উপরে ছিল। তবে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো তা ৯.৮৭ শতাংশে নেমে আসে। ধারাবাহিকভাবে এই প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে গত এপ্রিলে ৯ শতাংশের নিচে নেমে আসে। 

উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ১৬.৯৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৩২ শতাংশ। বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণের চাহিদা আছে অনেক; কিন্তু করোনাকালীন পরিস্থিতির কারণে ওই ঋণ আদায় করা সম্ভব হবে কি-না, এমন আশঙ্কা থেকে ঋণ বিতরণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার ঘোষিত প্যাকেজের বাইরে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না বললেই চলে। এজন্য এই মহামারির সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ অলস টাকা পড়েছে। অক্টোবর পর্যন্ত হিসাবে, ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। গ্রাহকদের মাঝে ঋণ বিতরণের পরিবর্তে ব্যাংকগুলো সরকারি বিল ও বন্ড কিনে রাখছে। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় সরকার প্রায় সোয়া লাখ কোটির টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নে গতি আসায় গত কয়েক মাস বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল। রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রফতানি আয় বাড়তে শুরু করেছিল। আমদানিও বাড়ছিল; কিন্তু কভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাব আবার বাড়তে থাকায় সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাচ্ছে। ফের সংকট আসছে মনে হচ্ছে’।

উল্লেখ্য, মহামারি মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে বড় শিল্প ও সেবা খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকা এবং কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (সিএমএসএমই) ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল অন্যতম। এই দুই তহবিলের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকা (১৫ হাজার ও ১০ হাজার কোটি টাকা) জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সরকারের এ ধরনের সহযোগিতার পরও অর্থনীতির একমাত্র ইতিবাচক দিক চলতি অর্থবছরের প্রথম চারমাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিট্যান্স এসেছে ৮৮২ কোটি ডলার। কিন্তু অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ওই অর্থ কাজে লাগছে না। ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে অলস টাকার পাহাড় বানাচ্ছে ব্যাংকগুলো।

শিল্প খাতকে চাঙ্গা রাখার মতো মালামাল আমদানি হচ্ছে না। নতুন শিল্প স্থাপন প্রায় বন্ধ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশ। শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৩৯ শতাংশ, মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২৪ শতাংশ, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৭ শতাংশ। 

ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের উদ্যোক্তা অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘শীতের আগমনে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমাদের মূল বাজারগুলো আবার হয়তো লকডাউনের মধ্যে পড়তে পারে। এতে আমাদের অর্থনীতি ভয়াবহ চাপে পড়তে পারে।’ 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘করোনাভাইরাসের শুরুতে প্রণোদনা বাস্তবমুখী পদক্ষেপ ছিল। তবে এই সুবিধা বড়রা পেলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাত ঠিকমতো পাচ্ছে না। অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে।’

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘এই মহামারির কারণে দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের পোশাক রফতানি খাত নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির দিকে গেছে। তবে আশা করছি, অচিরেই এই পরিস্থিতি থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব। যদি ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ভালোভাবে টিকে থাকতে পারি, তাহলে আর চিন্তা করতে হবে না। সেজন্য আমাদের প্রয়োজন আরেকটু সহায়তা।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //