নানান শঙ্কায় করোনা প্যাকেজ

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সারাবিশ্ব। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এর বাইরে নয়। ক্ষতির মাত্রা কমাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ওই সুবিধা বিতরণে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। 

ব্যাংক সমুদয় অর্থ কোথায় কীভাবে বিতরণ করছে, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য না থাকায় এই সন্দেহ আরো দানা বেঁধেছে। বিপুল পরিমাণ ঋণ পকেটে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া খেলাপিদের প্রণোদনার অর্থ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। 

আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য চিকিৎসা সামগ্রী আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে কি-না, সেটি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এর মধ্যে গ্রামের কৃষক ও ছোট উদ্যোক্তা, যাদের সহায়তা প্রয়োজন তারা চেষ্টা করেও প্রণোদনা পাচ্ছেন না।

করোনার সংক্রমণের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলায় এক লাখ ২০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এর মধ্যে নয়টি প্যাকেজের আওতায় ঋণ বিতরণ করছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। প্রণোদনার ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। বড় শিল্পপতিদের প্রণোদনা দ্রুত বিতরণ করলেও ছোট উদ্যোক্তা ও কৃষকদের প্রণোদনা বিতরণে ব্যাংকগুলো অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। 

এদিকে, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি কভিড-১৯ প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে পোশাক কারখানা মালিকদের নেয়া ঋণ পরিশোধের সময় আরো ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশ দেয়। নির্দেশনায় বলা হয়, ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে আরো ছয়মাস সময় প্রদান করা যেতে পারে। মোট ১২ মাস গ্রেস পিরিয়ড ছাড়া ১৮টি কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের শর্ত থাকতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘অর্থনীতির সব খাত করোনাভাইরাসের ক্ষতি থেকে সমানভাবে পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে পারছে না। বড় ও মাঝারি খাত এগিয়ে থাকলেও মাইক্রো ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটাই পিছিয়ে। এ হিসেবে বর্তমান পুনরুদ্ধারের গতি বড় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। এতে মাইক্রো ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থার অবনতি হচ্ছে। করোনাভাইরাস থেকে পুনরুদ্ধারে সরকারের ঘোষণা করা প্রণোদনা সব খাতে সমানভাবে বিতরণ হয়নি। জানুয়ারি পর্যন্ত কৃষি খাতের প্রণোদনার অর্ধেকও বিতরণ হয়নি। ব্যাংকের সাথে সম্পর্ক না থাকায় ছোট খাতের উদ্যোক্তারা প্রণোদনা পাচ্ছেন না।’

সরকারের হিসাব মতে, গত বছরের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.২ শতাংশ। এটি ধারাবাহিক বছরের তুলনায় অনেক কম হলেও আক্রান্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় ইতিবাচক। অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে প্রণোদনার অর্থ ভূমিকা রাখছে। তবে সেই প্রণোদনার অর্থ কোথায় বিতরণ করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

প্রণোদনার ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে তারল্য জোগান দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বড় শিল্পপতিদের ৪০ হাজার কোটি টাকা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপতিদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজের অর্ধেক দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শ্রমিকদের বেতনের পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। এর বাইরে অন্যান্য প্যাকেজের অর্থ পুনঃঅর্থায়ন হিসেবে দেয়া হয়েছে। এখন এই অর্থ দুর্বল ব্যাংকগুলো পেয়েছে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। যদি ভালো ব্যাংক বেশি পেয়ে থাকে, তাহলে তার ব্যবহার ভালো হবে। কিন্তু দুর্বল ব্যাংকগুলো বেশি পেয়ে থাকলে সেই অর্থের অপচয় হবে। কোন মানের ব্যাংক কতটুকু অর্থ পেয়েছে তার কোনো তথ্য নেই। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে প্রথমে ঋণ খেলাপিদের প্রণোদনা না দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু পরে সেটি প্রত্যাহার করায় খেলাপিদের প্রণোদনা দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। দেশে বর্তমানে তিন লাখ খেলাপি গ্রাহক রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেক প্রভাবশালী রাঘব বোয়ালও আছেন, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ব্যাংক খাতকে বিপাকে ফেলেছেন। 

আবার ব্যাংকগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক বাছাই করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। দেশের ব্যাংকের মালিকরা মূলত ব্যবসায়ী। ব্যাংকের মালিকরা নানা অজুহাতে ইতিপূর্বে নিজেদের সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন। তারা ব্যাংককে বিপদে ফেলে, আমানতকারীদের স্বার্থ বিবেচনা না করে নিজের স্বার্থে দাবি তুলছেন। এর আগে নিজেদের অনুকূলে আইন সংশোধন করে নিয়েছেন তারা। এখন ব্যাংক মালিক ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছেন কি-না, সেটি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। 

আবার এক সময় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। তা কমে গত ডিসেম্বর শেষে ৮৮ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। গত এক বছরের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিবর্তে কমেছে। কারণ করোনাভাইরাসের কারণে কোনো গ্রাহক ঋণ ফেরত দিতে না পারলেও তাকে খেলাপি না করার নির্দেশ রয়েছে। এই সুবিধা আরো এক বছর বাড়ানোর দাবি করেছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা। সুবিধাটি প্রত্যাহার করা হলেও, কি পরিমাণ ঋণ নতুন করে খেলাপি হবে, তার কোনো পরিসংখ্যানও নেই। 

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা অনেক দুর্বল। ব্যাংক ব্যবস্থায় বর্তমানে তিন লাখের বেশি খেলাপি রয়েছে। এখানকার ব্যবসায়ীদের ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এ অবস্থায় প্রণোদনার ঋণের মেয়াদ সুনির্দিষ্ট করতে হবে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘প্রণোদনার অর্থ বিতরণের পরও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অলস টাকার পাহাড় জমা হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকে বাড়তি তারল্যের পরিমাণ ২.০৫ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বাড়তি তারল্য দ্বিগুণেরও বেশি।’ এ অবস্থায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি অবলম্বনের পরামর্শ দেন তিনি।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রফতানি আয় ৫ শতাংশ কমে গেছে। আর আমদানি বেড়েছে মাত্র আড়াই শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি আগের তুলনায় অনেক কমেছে। এই সময়ে করোনাভাইরাস চিকিৎসাসামগ্রী, ওষুধ, পিপিই, মাস্ক ইত্যাদি আমদানি-রফতানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো পরিশোধ গ্যারান্টি পায়নি ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। পাচারের ৮০ শতাংশ হয় ব্যাংকের মাধ্যমে আমাদানি-রফতানি বাণিজ্যের নামে। এখন করোনাভাইরাসের সুযোগে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কি-না, সেটি নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো সংকটে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যয় বাড়িয়ে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করা পুনরুদ্ধারের একটি জনপ্রিয় অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। সরকারের ব্যয় বাড়লে, জনসাধারণের কাছে অর্থ প্রবাহ বাড়লে পণ্য ও সেবার চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে। এ সুযোগ কাজে না লাগিয়ে এ কঠিন সময়ের মধ্যেও সরকারের ব্যয়ে সংকোচন করা হয়েছে। এই সময়ে আমদানি-রফতানি হচ্ছে কিছুটা শিথিলতার মধ্য দিয়ে।’ 

তিনি বলেন, ‘নানা কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই শিথিলের সুযোগ দিয়েছে; কিন্তু এর ব্যবহার করে অর্থ পাচার হচ্ছে কি-না, সেটিও দেখতে হবে। প্রণোদনার অর্থ কোথায় কীভাবে যাচ্ছে, তার তাৎক্ষণিক তথ্য প্রকাশ করা উচিত। তথ্য না থাকলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এছাড়া নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //