বিদ্যুতের ভূতুড়ে বিল, দায় কার

বাড়তি বিদ্যুৎ বিলের অভিযোগ কমবেশি সব সময়ই ছিলো। করোনার দুঃসময়ে সেটি আরো বেড়েছে। শহর কিংবা গ্রাম সবখানে একই অবস্থা। বিশাল অঙ্কের ভূতুড়ে বিল দেখে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর বিপদ আরো বেশি। এক মাসে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন তার পরিবর্তে যে পরিমাণ ব্যবহার করেননি, সেটারই বিল ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রাহককে।

এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হলে কেউ প্রতিকার পান আবার কেউ পান না। হয়রানি কিংবা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার ভয়ে অনেকে ভূতুড়ে বিলই পরিশোধ করেন।

গ্রাহক যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সেই স্লটের ওপর বিদ্যুৎ বিল নির্ধারণ করে বিতরণকারী সংস্থা-কোম্পানিগুলো। এর সাথে ডিমান্ড চার্জ এবং মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) যুক্ত হয়। একজন গ্রাহক যত বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তার মাসিক বিল তত বেশি মূল্যহারে নির্ধারিত হয়।

লাইফ লাইনসহ (৫০ বা তার চেয়ে কম ইউনিট ব্যবহারকারী) সাত শ্রেণিতে গ্রাহকদের ভাগ করেছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সে অনুযায়ী মাসে ০ থেকে ৭৫ ইউনিট (কিলোওয়াট) পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে গ্রাহককে প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ১৯ পয়সা হারে বিল দিতে হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপের (৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট) প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ৭২ পয়সা, তৃতীয় ধাপে (২০১ থেকে ৩০০) ৬ টাকা, চতুর্থ ধাপে (৩০১ থেকে ৪০০) ৬ টাকা ৩৪ পয়সা, পঞ্চম ধাপে (৪০১ থেকে ৬০০) ৯ টাকা ৯৪ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের ষষ্ঠ ধাপের গ্রাহক হিসেবে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা হারে বিল শোধ করতে হয়।

একজন গ্রাহক মাত্র ১ ইউনিট বিদ্যুতের কারণে পরের ধাপের বিলিংয়ে পড়ে যেতে পারেন। এতে তার টাকার অঙ্কেও হতে পারে ব্যাপক তারতম্য। তাই মিটার রিডাররা চাইলেই ইউনিট কমবেশি লিখে ভূতুড়ে বিলের ফাঁদে ফেলে দিতে পারে যেকোনো গ্রাহককে।

গ্রাহকরা জানান, শীত এবং গরমকালে  বিদ্যুৎ ব্যবহারে পার্থক্য হয়। শীতকালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) এবং ফ্যানের ব্যবহার কম হওয়ায় বিদ্যুতের ব্যবহারও কমে। আর গরমে সেটি বেড়ে যায়। গ্রাহক অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কোন বাসায়  প্রতি মাসে হয়তো ৪০০ ইউনিটের মধ্যে বিদ্যুৎ ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকে। সে হিসেবে ডিমান্ড চার্জ ও ভ্যাট ছাড়া ঐ বাসার বিদ্যুৎ বিল আসবে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫৩৬ টাকা।

কিন্তু মিটার রিডার দুই মাস রিডিং না নিয়ে বা মিটার না দেখেই তার মাসিক বিল করে ৩৫০ ইউনিট। পরে তৃতীয় মাসে গিয়ে তিনি আগের দুই মাসের সঞ্চিত ১০০ ইউনিট ঐ মাসের সাথে যোগ করে ৫০০ ইউনিটের বিল তৈরি করলেন। ব্যবহারের এ পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে গ্রাহক চতুর্থ থেকে পঞ্চম ধাপের গ্রাহক হিসেবে হাতে বিল পান। অথচ প্রকৃত অর্থে তিনি চতুর্থ ধাপের গ্রাহক।

বিলিং জালিয়াতির কারণে ঐ গ্রাহককে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৬ টাকা ৩৪ পয়সার পরিবর্তে ৯ টাকা ৯৪ পয়সা হারে পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ ২ হাজার ৫৩৬ টাকার পরিবর্তে ৪ হাজার ৯৭০ টাকা বিল দিতে হয়।  মিটার রিডার আগের দুই মাসের জমে থাকা ইউনিট এই মাসে ঢুকিয়ে দেয়ার কারণে খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এ অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করা কঠিন। সে কঠিন দায়ই বছরের পর বছর বয়ে বেড়াচ্ছেন অগণিত গ্রাহক।

রাজধানীর দুই বিতরণ সংস্থা ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ৮০টি সমিতির গ্রাহকের এই অবস্থা। এছাড়া একই অভিযোগ উত্তরের কয়েকটি জেলায় বিতরণ সংস্থা নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো), দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার বিতরণ সংস্থা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) এবং দেশের সীমিত এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহকদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো কাজ করে থাকে এবং একটি লক্ষ্যমাত্রাও ধরা থাকে। অর্থ বছরের শেষ দিকে এসে সংস্থাগুলো ঘাটতি মেটাতে গ্রাহকদের ওপর বেশি বিল চাপিয়ে দেয়। হয়রানির আশঙ্কা ও প্রতিকার না পাওয়ার হতাশা থেকে অনেক গ্রাহক আপত্তি করেন না। ফলে ভূতুড়ে বিল করেও সংস্থাগুলো মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয় গ্রাহকদের কাছ থেকে। 

গত বছর ‘ভূতুড়ে বিল’ নিয়ে গ্রাহক অসন্তোষ দেখা দিলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে, বিতরণ প্রতিষ্ঠান পিডিবির মোট ৩২ লাখ ১৮ হাজার ৫১৫ জন গ্রাহকের মধ্যে বিল নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে দুই হাজার ৫৮২টি; যা মোট গ্রাহকের ০.০৮ শতাংশ।

তবে এমন অসঙ্গতিপূর্ণ বিলের সংখ্যা আরো বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সব বিল নতুনভাবে যাচাই করলে সব গ্রাহক সঠিক বিল পেতে পারতেন বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম।

তিনি বলেন, এভাবে বিল করার ক্ষমতা বিতরণ সংস্থাগুলোর নেই। বিইআরসির বেধে দেয়া নিয়মের বাইরে এ ধরণের বিল করা হলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জনগণের ওপর এমন অত্যাচার বিতরণ সংস্থাগুলো কোনভাবেই চাপিয়ে দিতে পারে না, এটি অন্যায়।

ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাওসার আমীর আলী বলেন, মিটার রিডিংয়ের ব্যাপারে আমাদের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি গ্রাহকদেরও দায়িত্ব আছে সচেতন হয়ে সঠিক ইউনিট অনুযায়ী বিল বুঝে নেয়ার। কোম্পানির প্রতিনিধি ভুল করলে সেটি গ্রাহক ধরিয়ে দিতে পারেন।

প্রতিটি মিটারের সাথে মিটার কার্ড দেয়া থাকে। সেটিতে মিটার রিডারের প্রতি মাসের রিডিং লিপিবদ্ধ করার নিয়ম রয়েছে। গ্রাহক এটি সংরক্ষণ এবং মিটারের সাথে মিলিয়ে নিলেই এই ভুল এড়িয়ে যাওয়া বা সংশোধন করা সম্ভব হয়। আর স্থায়ী সমাধানের জন্য সব গ্রাহককেই প্রিপেইড মিটার দেয়ার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যে সব গ্রাহকের আঙিনায় প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //