চ্যালেঞ্জের মুখে ই-কমার্স

টাকা ফেরত নিয়ে গ্রাহকরা শঙ্কিত

ই-ভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের কর্ণধাররা এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বন্দি। এ অবস্থায় নিজেদের অর্থ ফিরে পাওয়া নিয়ে আতঙ্কিত লাখ লাখ গ্রাহক। শুধু এ দুটিই নয়, প্রতিদিনই নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে সারাদেশে একই কায়দায় লোভনীয় অফারের ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠছে।

গত দুই বছরে করোনা মহামারির কারণে ঘোষিত লকডাউনে সাধারণ মানুষ অনলাইন কেনাকাটায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আর এ সুযোগেই প্রতারক চক্রগুলো ই-কমার্সের নামে এ ধরনের প্রতারণা শুরু করে। প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক গ্রেফতার হবার পর তাদের গ্রাহকদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কারাগারে, অফিস বন্ধ, ব্যাংক হিসাবে পর্যাপ্ত তহবিল নেই। প্রতিষ্ঠান হিসাবে ই-ভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের এখন কী হবে? এ ছাড়া যারা পণ্য কিনতে টাকা দিয়েছেন, তাদের টাকা ফেরত পাবার উপায়ই বা কী?

ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, ধামাকাসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের যেসব গ্রাহক অর্থ পরিশোধের পরও, পণ্য পাননি তাদের সে অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারকে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে টেলি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)।

টিক্যাবের আহ্বায়ক মুর্শিদুল হক বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন সুচতুর প্রতারণা প্রকাশের পর এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এর দায় কার? অবশ্যই এর প্রধান দায় প্রতারক চক্রের, এরপর দায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের- যারা সময়মতো তদারকি করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। আর সবশেষে কিছুটা দায় গ্রাহকদের ওপরেও বর্তায়, যারা বাস্তবতা বিবেচনা না করে লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়েছেন। দায় যারই হোক, গ্রাহকরা রাষ্ট্রের নাগরিক। তারা প্রতারণার শিকার হলে, তাদের ন্যায় বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। সে অর্থ ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন হবে বলে, আমরা মনে করি না। যদি সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করে গ্রাহকদের অর্থ তাদের মাঝে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়, তবে তা দেশের ইতিহাসে যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। 

তিনি আরও বলেন, গ্রেফতারের আগে গ্রাহকদের প্রায় ১১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে মালিকানা পরিবর্তনের নাটক সাজিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে ই-অরেঞ্জ। ফেব্রুয়ারিতে ই-ভ্যালির দায় ছিল ৪০৩ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪৩ কোটি টাকায়। দায় মেটাতে সময় নিয়ে উল্টো দায় বাড়িয়েছে ই-ভ্যালি। 

আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের কারণে যখন অসংখ্য মানুষ আর্থিকভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন হন, তখন পরিস্থিতি সামলাতে সেসব প্রতিষ্ঠানে আদালতের আদেশে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারে সরকার। প্রশাসক সরকারের পক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করবে।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল ওয়াাহেদ তমাল বলেন, যেহেতু এখানে অনেক মানুষের স্বার্থ জড়িত, সরকার চাইলে প্রতিষ্ঠানটি নিজেরা পরিচালনা করতে পারে অথবা কোনো একটা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে পারে।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান হাফিজুর রহমান বলছেন, ‘সরকার তো চাইলেই প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে না। আদালত আদেশ দিলে, তখন সরকার প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে। বিষয়টি নিয়ে যেহেতু মামলা হয়েছে, আইনি প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সেখানে আদালত যদি আদেশ দেয়, তখন সরকার সেটি পালন করবে। তদন্তে কি বেরিয়ে আসে, আদালত কী বলেন, সেটা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

টাকা ফেরত পাবেন কি-না, শঙ্কায় ই-ভ্যালির গ্রাহকরা : দীর্ঘদিন ধরে পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে ক্যাশব্যাকের নামে গ্রাহকের টাকা আটকে রেখে সমালোচনার তোপে আছে অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্ম ই-ভ্যালি। 

কয়েক সপ্তাহ ধরে ই-ভ্যালির কার্যক্রম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলছিল। অনেকে ই-ভ্যালিতে অর্ডার দিয়েও ৩-৪ মাস ধরে পণ্য বা টাকা ফেরত না পাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করছিলেন। অনেকে আবার ক্যাশব্যাক অফারে কমদামে পণ্য পাওয়ায় ই-ভ্যালির কাছে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন।

এসএস হাসান নামে এক গ্রাহক বলেন, আমি গত ২৯ জুন ও ১ জুলাই ৫টি পণ্য অর্ডার দেই। প্রায় দুই মাস হয়ে গেলেও তিনটি পণ্য এখনো ‘প্রসেসিং’ দেখাচ্ছে, বাকি দুটি ‘অর্ডার পিকড’ হয়ে পড়ে আছে। তিন হাজার ৫০০ টাকা ওয়ালেটে রিফান্ড নিয়েছি ফুড অর্ডার করার জন্য। এখন এই সার্ভিসও বন্ধ। পণ্য বা টাকা আদৌ ফেরত পাব কি-না, এ নিয়ে আমি এখন শঙ্কিত।

ই-ভ্যালিতে বর্তমানে ৩৫ লাখ গ্রাহক নিবন্ধিত রয়েছেন। প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটি ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন করে। প্রতিষ্ঠার পর ২০ মাসে গ্রাহকের কাছে দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে ই-ভ্যালি।

এদিকে ই-অরেঞ্জের মালিকপক্ষ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের সামনে বসে পণ্য বা টাকা ফেরত (রিফান্ড) দেওয়ার লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়, এমন দাবি জানিয়েছেন ই-অরেঞ্জের ভুক্তভোগী গ্রাহকরা। এর মধ্যে সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের কাছে তারা এ ব্যাপারে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। আবেদনে তারা পণ্য বা টাকা ফেরত পেতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

আবেদনে বলা হয়েছে, ই-অরেঞ্জ তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে পণ্য বা টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বারবার। আর তা বারবারই ভঙ্গ করছে। পরের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সামনাসামনি বসে। মালিকপক্ষ গ্রাহকদের টাকা কীভাবে ফেরত দেবে এবং কত দিনের মধ্যে ফেরত দেবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে হবে। পণ্য বা টাকা ফেরতের আলোচনার সময় সামার ভাউচার ও স্বপ্ন ভাউচারের টাকা ফেরতের লিখিত প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে।

আরও বলা হয়েছে, ই-অরেঞ্জের মালিক পক্ষের লিখিত বক্তব্য স্ট্যাম্পে দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনোভাবেই তার নড়চড় না হয়। সাগর সরকার নামের এক গ্রাহকের নেতৃত্বে চারজন গ্রাহক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমানের কাছে আবেদনপত্র জমা দেন। মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ই-অরেঞ্জের কাছে আমরা তথ্য-উপাত্ত চেয়েছি। গ্রাহকদের আবেদনও এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য-উপাত্ত পেয়ে আমরা পরের পদক্ষেপ নেব।’

ই-অরেঞ্জের মালিকপক্ষ প্রতারণামূলকভাবে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে তাহেরুল ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগী গ্রাহক গুলশান থানায় মামলা করেছেন। মামলার আসামিদের মধ্যে ই-অরেঞ্জের মূল মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে, আদালত জামিন না দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //