ঝুঁকিহীন, চাঙা কৃষি অর্থনীতি

করোনার প্রকোপেও বিদায়ী বছরে দেশের কৃষি অর্থনীতি চাঙাই ছিল। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি ঝুঁকিমুক্তই ছিল। করোনা তেমন কোনো আঘাত করতে পারেনি কৃষিখাতকে। করোনাকালে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে কৃষি।

মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ অবদান কৃষি ও সেবা খাতের। কর্মসংস্থানেও বড় ভূমিকা রাখছে খাতটি। আয় কমে যাওয়ায় শহরত্যাগী মানুষগুলোকেও ধারণ করেছে গ্রামীণ অর্থনীতি। তবে কমেছে এই খাতে ঋণ প্রবাহের পরিমাণ। ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, কৃষির বহুমুখীকরণের মাধ্যমেই অর্থনীতিকে চাঙা রাখা সম্ভব হয়েছে। তবে কৃষি ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়াতে পারলে উৎপাদনশীলতা আরও বাড়বে, যা দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির পাশাপাশি সার্বিক অর্থনীতির চাকার গতি আরও বৃদ্ধি করবে। মহামারির ওই সংকটে অর্থনীতির চাকা যেটুকু সচল ছিল, তার মূল কৃতিত্ব কৃষি খাতের। তবে কৃষক পর্যায়ে সুবিধা বাড়াতে হবে সরকারকে। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনাকালে গত বছরের তুলনায় খাদ্য উৎপাদন আরও বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছে দুই কোটি টনের বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একই সময়ে মোট চাল উৎপাদিত হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ, গম ১২ লাখ, ভুট্টা প্রায় ৫৭ লাখ, আলু ১ কোটি ৬ লাখ, শাকসবজি ১ কোটি ৯৭ লাখ, তেল জাতীয় ফসল ১২ লাখ ও ডালজাতীয় ফসল ৯ লাখ টন। দেশে চলতি বছরে ১ কোটি ২১ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। ১০ বছর আগের তুলনায় উৎপাদন ১৮ লাখ টন বেড়েছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, অর্থবছরের শুরুটা বেশ ভালোভাবেই হয়েছে। প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে কৃষিপণ্য রফতানি থেকে ২০ কোটি ৭২ লাখ ৩০ হাজার ডলার আয় হয়েছে। টাকার হিসাবে এই অর্থ ১ হাজার ৭৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। উল্লিখিত দুই মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বছরে প্রায় ৩ শতাংশ চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে। কৃষি যন্ত্রায়ন যথেষ্ট নেই। গ্রামের জনসংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, সে হারে কৃষির সুবিধা বৃদ্ধি পায়নি। ফলে বাধ্য হয়ে কৃষিতে আশার দিক না পেয়ে শহরমুখী হচ্ছে মানুষ। আসলে কৃষিতে সফলতা পেতে হলে আরও সহযোগিতা বাড়াতে হবে। যারা শহরে চলেই এসেছে তাদের জন্য সার্ভিস এবং শিল্প খাতেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা দরকার। আর যারা গ্রামে রয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে অনেক ছোট কৃষক বা বর্গাচাষি রয়েছে। তাদের কৃষিব্যয়ের ঘাটতি থাকার কারণ হলো ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি করে দেওয়া। অথবা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হওয়া। এর কারণ ফসল সংরক্ষণ করার কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের। সে ফসল যদি পরে বিক্রি করার সুযোগ তাদের থাকত তাহলে এমন সমস্যা হতো না।

বর্তমানে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত। কৃষিতে বহুমুখীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৮০ ভাগকে নিয়োজিত করে দেশে কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব।

এ দিকে করোনাভাইরাসের সংকটকালে দেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে এবং বিনিয়োগ খরা কাটাতে উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ কিছু খাতে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে। এর মধ্যে কৃষিপণ্যের ছয় খাতে থাকছে ১০ বছরের কর অবকাশ। ফল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন, সম্পূর্ণ দেশীয় কৃষি হতে শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী শিল্প এবং কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনে নতুন বিনিয়োগে থাকবে ১০ বছরের করমুক্তি সুবিধা।

২০৩০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যারা এই খাতে বিনিয়োগ করবেন, তারা এই আয়কর অব্যাহতির সুবিধা পাবেন। এই করমুক্তি সুবিধা নিতে ন্যূনতম এক কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে বিডার নিবন্ধন নিতে হবে। তবে কাঁচামাল পুরোটাই দেশে উৎপাদিত হতে হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষক। আর গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে কৃষি। এই কৃষি ক্ষেত্রের বিষয়টি ভালোই দেখছি। শস্য উৎপাদনও ভালোই চলছে। আমাদের কৃষিমন্ত্রী তো এ খাতে অনেকটা বিপ্লব ঘোষণা করেছেন। তাই কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব চলছে। যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হয়, তাহলে যথেষ্ট সন্তোষজনক সম্ভাবনা রয়েছে।

কৃষি ক্ষেত্রেও যে ঋণের প্রবাহ দেখছি, সেটাও ভালোই আছে। তবুও সেটা কিছুটা কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ছিল ৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে এসে কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। কাজেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের কোনো ঝুঁকি নেই যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ না আসে। তবে একটি দুঃখের বিষয় যে, অনেক চাষি চাষ করতে যে ব্যয় করে তা আর পূরণ হয় না। বড় ধরনের ঘাটতি থেকে যায়। ফলে দিন দিন কৃষক ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন। ঋণগ্রস্ত হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ছুটে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। 

তার মতে, স্থানীয় কিছু সিন্ডিকেট লোভের বশবর্তী হয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। একইভাবে কৃষিতে কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। নানা সমস্যার সঙ্গে নদীভাঙনও এর করুণ পরিণতি নিয়ে আসে। আবার কখনো অবকাঠামো বা রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, শিল্প-কারখানা ইত্যাদি নির্মাণের কারণে চাষযোগ্য জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, দেড় বছর ধরে করোনা মহামারির আক্রমণে দেশের শিল্প ও সেবা খাত তছনছ হয়ে গেছে, এখনো হচ্ছে। যত দিন না পর্যন্ত আমরা দেশের বেশির ভাগ মানুষকে টিকা দিতে না পারব, ততদিন এই দুই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।

তিনি আরও বলেন, সুখের বিষয় হচ্ছে, এই দেড় বছরে আমাদের কৃষি খাতের কোনো ক্ষতি হয়নি। উল্টো এ খাতের উৎপাদন আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। কৃষক ধান, পাটসহ অন্যান্য ফসলের ভালো দাম পেয়েছে। তার প্রতিফলনই আমরা দেখতে পাচ্ছি পরিসংখ্যান থেকে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //