বঙ্গোপসাগর- বাংলাদেশের ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’

সমুদ্রের বিশাল জলরাশি ও এর তলদেশের বিপুল পরিমাণ সম্পদকে কাজে লাগানো হয়। দেশের অর্থনৈতিক চাকা শক্তিশালী করতে সমুদ্র অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমি হচ্ছে সমুদ্রের সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। যার অর্থ হলো, সমুদ্র থেকে যা–ই আহরণ করা হোক না কেন, যদি সেটা দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়, তবে সেটা ব্লু -ইকোনমির বা সুনীল অর্থনীতির পর্যায়ে পড়বে।  

সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বিরোধ মীমাংসার পর বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকার মালিকানা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই এলাকায় মৎস্য আহরণ ও সমুদ্রের তলদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। 

২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার মামলায় মোট প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায় বাংলাদেশ। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জন্য ১২ নটিক্যাল মাইল রাষ্ট্রাধীন সমুদ্র এলাকা, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল সীমানা এবং মহীসোপানে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ।  

এরপর ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্র সীমানার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ।  

ঐতিহাসিক এই সমুদ্রবিজয় দেশের অর্থনীতিকে এক যুগান্তকারী সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। সমুদ্র অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমির সঠিক ব্যবহার ও যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

সমুদ্র অর্থনীতি থেকে যেসব সম্পদ পায় বাংলাদেশ

মাছ ও প্রাণীজ সম্পদ

বিশ্বের প্রতিবছর ৮ কোটি ৪৪ লাখ টন সামুদ্রিক খাবার আহরণ করা হয়। সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু বিশ্বের মানুষকে ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে বলে জানায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা।

২০১৭-২০১৮ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সাড়ে ছয় লাখ টন মাছ এসেছে সমুদ্র থেকে।

প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে আশি লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র ৭ লাখ টন মাছ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ আওয়ার সি এ তথ্য নিশ্চিত করে। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এখনো সমুদ্র থেকে মাছ এবং চিংড়ি বেশি ধরা হয়। কারণ খাবার হিসাবে বাংলাদেশিদের ভেতরে এগুলোর চাহিদাই বেশি রয়েছে। তবে ইদানীং অনেক জায়গায় অক্টোপাস, স্কুইড, ক্যাটলফিস, কাঁকড়া বা ঝিনুক খাওয়ার চল তৈরি হয়েছে।’

অক্টোপাস, ক্যাটলফিস,কাঁকড়া, বা স্কুইডের স্থানীয় বাজারে চাহিদা কম থাকলেও এগুলোও প্রচুর পরিমাণে ধরা হয়। কারণ এসব মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়।

অধ্যাপক সাইদুর জানান, বাংলাদেশের সমুদ্র থেকে মূলক লাক্ষা, রূপচাঁদা ও কালোচাঁদা, টুনা, ম্যাকারেল, লইটা, চ্যাপা, সামুদ্রিক রিটা, শাপলা পাতা মাছ, তাইল্লা, পোয়া, সুরমা, ইলিশ, ছুরি, ফাইস্যা, সামুদ্রিক বাইন ও কই মিলিয়ে প্রায় ২০টির মতো বাণিজ্যিক আকারে মাছ ধরা হয়। কারণ এসব মাছের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা রয়েছে।

সবমিলিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে খাদ্য হিসাবে দুইশ প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি মিলিয়ে ৪০টির মতো মাছ নিয়মিত ধরে বাংলাদেশের জেলেরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু মাছের দেশের ভেতরে তেমন চাহিদা না থাকলেও বিদেশে চাহিদা থাকায় ধরা হয়। যেমন হাঙ্গর ধরা নিষিদ্ধ হলেও এটির পাখনার চাহিদা থাকায় গোপনে জেলেরা ধরে বিক্রি করে। কিন্তু ছোটবড় মিলিয়ে এতো বেশি হাঙ্গর ধরা হয়েছে যে, হাঙ্গরের সংখ্যা এখন ঝুঁকিতে পড়ে গেছে।

কক্সবাজারের একজন ট্রলার মালিক জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের মাছ বেশি ধরি। ইলিশ মৌসুমে যেমন ইলিশ বেশি ধরা হয়। এছাড়া সাগরের অন্যসব মাছও আমরা ধরি। কিছু মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়ে যায়, কিছু আবার শুঁটকি হয়, রপ্তানি হয়।’

তিনি জানান, বাংলাদেশের জেলেরা দক্ষিণে মিয়ানমারের সীমানা আর পশ্চিমে ভারতের সীমানা পর্যন্ত গিয়ে মাছ ধরে।

শৈবাল, শামুক ও ঝিনুক

মাছের বাইরেও বঙ্গোপসাগরের কিছু উদ্ভিদ এবং শামুক-ঝিনুকের চাহিদা রয়েছে দেশে ও বিদেশে।

অধ্যাপক সাইদুর বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে শামুক, ঝিনুকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়া বিদেশেও এটা রপ্তানি হয়। ফলে বাংলাদেশে এটি প্রচলিত একটি খাবার না হলেও সমুদ্র থেকে এটাও আহরণ করা হয়।’

সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রায় দুই বছর ধরে গবেষণা করে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, পাঁচ প্রজাতির লবস্টার, ছয় প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের কিছু প্রজাতির সি উইডে প্রচুর প্রোটিন আছে যা ফিস ফিড হিসেবে আমদানি করা ফিস অয়েলের বিকল্প হতে পারে। আবার কিছু প্রজাতি অ্যানিমেল ফিডের মান বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হতে পারে।

তিন ধরণের সি-উইডের মধ্যে সবুজটি সাধারণত খাবার বা সালাদ হিসেবে খাওয়া হয়। আর লালটি হাইড্রোকলয়েড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। আর বাদামি সি-উইড খাবার ও হাইড্রোকলয়েড উৎপাদন দুই কাজেই ব্যবহার হয়।

হাইড্রোকলয়েড উৎপাদন সাধারণত শিল্প উৎপাদনে জলীয় কাঁচামাল হিসেবে কাজে লাগে। কসমেটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এমন কিছু উপাদান পাওয়া যায় এমন সি উইডও অনেক পাওয়া গেছে সমুদ্রে।

বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞানী ড. মো. কাউসার আহম্মেদ বলেন, ‘৪০টির বেশি মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণীর বাণিজ্যিক মূল্য নেই। যদিও ধরা হয় প্রায় দুইশর মতো প্রজাতি। বাকিগুলো সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়।’

অনেক সময় জেলেদের জালে কচ্ছপ ধরা পড়তো। কখনো কখনো এসব কচ্ছপ গোপনে বিক্রিও করা হতো। বর্তমানে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী হিসাবে কচ্ছপ নিধন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

লবণ উৎপাদন

বাংলাদেশের জলসীমায় সমুদ্র থাকার বড় একটি সুবিধা হলো, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে লবণ উৎপাদন।

উপকূলে সমুদ্রের পানি ধরে, রৌদ্র বা সৌরশক্তি ব্যবহার করে শুকিয়ে অপরিশোধিত লবণ আহরণ করা হয়।

বর্তমানে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের এক লাখ একরের বেশি জমিতে লবণ চাষ করা হয়। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ১৮ লাখের বেশি মানুষ।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের হিসাবে, বাংলাদেশে অপরিশোধিত লবণের চাহিদা ছিল ১৬.৫৭ লাখ মেট্রিকটন, তবে সারা দেশে উৎপাদন হয়েছে ১৩.২৫ লক্ষ মেট্রিকটন। অর্থাৎ দেশের লবণের চাহিদার বড় একটি অংশ সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়।

গ্যাস ও খনিজ সম্পদ

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান করে সমুদ্রে ও তলদেশে গ্যাস-হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাসের জমাট স্তরের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন।

তাদের ধারণা, বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় ০.১১ থেকে ০.৬৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট সম্ভাব্য প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট জমার অনুমান পাওয়া গেছে যা ১৭-১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের সমান।

বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে গভীর ও অগভীর সমুদ্রসীমায় ২৬টি ব্লক রয়েছে। সেসব ব্লকে তেল ও গ্যাস রয়েছে কি না, সেজন্যও বাংলাদেশের বাপেক্স ও কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে।

১৯৯৬ সালে সমুদ্রের নয় নম্বর ব্লকে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছিল কেয়ার্নস এনার্জি। তবে গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালে সেটি পরিত্যক্ত হয়েছে।

বর্তমানে চার নম্বর ব্লকে ভারতীয় একটি কোম্পানি অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ আরও তিনটি ব্লক ইজারা দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করবে পেট্রোবাংলা।

অধ্যাপক সাইদুর বলেন, ‘সমুদ্রে তেল ও গ্যাস রয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে। এখানে নতুন গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কার হলে সেটা দেশের জন্য ব্লু ইকোনমির আরেকটি বড় শক্তি হয়ে উঠবে।’

তেল গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে সালফার, মেটালিক মডিউল, কোবাল্ট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দেশের মেরিন ও উপকূলীয় অঞ্চলে সব প্রকার সমুদ্র সম্পদ আহরণ, বাণিজ্যিক জাহাজ, জ্বালানি, পর্যটন ইত্যাদি ঘিরে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে এবং এ জন্য নয়টি খাতকে সুনির্দিষ্ট করে কাজ চালাচ্ছে বাংলাদেশ।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //